একটা জোয়ান লোক হঠাৎ ছলোছলো চোখে তার সামনে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, “ওস্তাদ, শ্রীচরণে একটু ঠাঁই দিতে হবে যে!”
দুর্গা সতর্ক হয়ে এক পা পিছিয়ে বলল, “কে রে তুই?”
“অধমের নাম পীতাম্বর। আজ স্বচক্ষে যা দেখলাম এরপর নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে। পায়ে ঠেলবেন না ওস্তাদ, চাই কী
আপনার ঘর ঝটপাট, বাসন মাজা সব করতে রাজি আছি।”
দুর্গা খুশির হাসি হেসে বলল, “আরে হবে, হবে। দু’দিন সবুর কর। একটু গুছিয়ে টুছিয়ে নিই তারপর দল খুলব। তখন আসিস।”
“না ওস্তাদ, এ সুযোগ আর পাব না। আপনি আমাকে কি আর তখন মনে রাখবেন? সে হবে না, এখনই শ্রীচরণে ঠাঁই দিতে হবে।” বলেই নোকটা দড়াম করে পায়ের ওপর পড়ে দুটো পা চেপে ধরল।
“আহা, করিস কী, করিস কী রে আহাম্মক!”
আর একটা লোক হঠাৎ পাশ থেকে উদয় হয়ে বলল, “আহা হা পীতাম্বর, ও কী হচ্ছে? তুমি দু-দুটো পা দখল করে থাকলে আমরা যাব কোথায়?” বলে এ লোকটাও পা চেপে ধরে ডুকরে উঠল, “মারুন, কাটুন, যা খুশি করুন, চরণ আর ছাড়ছি না গুরু!”
দুর্গা ফাঁপরে পড়ে আঁকুপাঁকু করছে। এমন সময়ে আরও একজন উদয় হল, কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে মিহিন সুরে বলল, “সীতার বনবাস দেখেও এমন কাঁদিনি, আজ আপনার হাতের কাজ দেখে আনন্দে যত কেঁদেছি। স্বপ্ন দেখলাম নাকি বুঝতে পারছি না। ওরে বাপু, পা দু’খানা দখল করে থাকলে আমাদের কি চলে!”
এ লোকটা পা দখল করতে না পেরে হাঁটু জাপটে বসে পড়ল। দুর্গা মালো চেঁচাতে লাগল, “ওরে ছাড়, ছাড়! কথা দিচ্ছি তোদের দলে নেব।”
এমন সময় আরও পাঁচ-সাতজন একসঙ্গে বলো দুর্গা মালো কি জয়… বলো দুর্গা মালো জিন্দাবাদ… বলো দুর্গা মালো জগতের আলো..’ বলতে বলতে এসে একেবারে ঘিরে ফেলল দুর্গাকে। একজন কোমর জড়িয়ে ধরল, আর একজন পেট, আর দু’জন দু’হাত ধরে ঝুলে পড়ল, একজন গলা পেঁচিয়ে ঘাড় এমন টাইট মারল যে, দুর্গার দম বন্ধ হয়ে এল।
“ওরে করিস কী? করিস কী?”
কে শোনে কার কথা! হাতগুলো ক্রমে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরছে। চোখ উলটে দুর্গা গোঁ গোঁ করতে লাগল। তারপর আর তার জ্ঞান রইল না।
একটু দূর থেকে দৃশ্যটা খুব মন দিয়ে দেখছিল হাঁদু। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর লোকগুলো খুব যত্ন করে দুর্গা মালোকে মাটিতে শুইয়ে দিল। একজন কোমর থেকে গামছাটা খুলে নিল। আর একজন দুর্গার ট্যাঁক আর পকেটে যা ছিল বের করে নিল। তারপর ধীরেসুস্থে ভিড়ের মধ্যে একে একে মিশে গেল। হাঁদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর গুটি গুটি ফিরে চলল রসো পান্তির কাছে।
.
“আহা মশাই, খোকাটিকে অমন ঢেকেঢুকে নিচ্ছেন, ওর দমবন্ধ হয়ে যাবে যে!”
নবকান্ত থমকে দাঁড়িয়ে টেকো আর গুফো লোকটার দিকে চেয়ে বলল, “কীসের খোকা? কার খোকা?”
“আপনার চাঁদরের তলায় ওটি খোকা নয়?”
“আজ্ঞে না।”
“তা হলে কী বলুন তো! জুতোর বাক্স নাকি?”
“আজ্ঞে না।”
“তা যা-ই হোক, সাবধানে নেবেন। বড্ড চুরি-ছিনতাই হচ্ছে এই ঝিকরগাছার হাটে। এই তো শুনলুম একটু আগে নবীন পাকড়াশির দোকান থেকে ক্যাশবাক্স উধাও হয়েছে। দেশটা চোরে-ডাকাতে ভরে গেল মশাই।”
“তা হবে।”
“শুধু কি চোর! শুনলেন না একটু আগে মাইকে বলছিল, শীতল দাসের খুনি শ্যামাপদ নাকি জেল থেকে পালিয়ে এই দিকেই এসেছে। ধরে দিতে পারলে দশ হাজার টাকা পুরস্কার।”
শীতল দাসের খুনি শ্যামাপদ শুনে নবকান্তর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। একটু আগে না একটা লোক তাকেই শ্যামাপদ বলে ভুল করেছিল! কী সর্বনাশ! সে কি শ্যামাপদর মতো দেখতে নাকি!
ক্ষীণ স্বরে নবকান্ত বলল, “তাই নাকি?”
“তবে আর বলছি কী! ভয়ংকর খুনি মশাই। হাটসুষ্ঠু লোক তো পুরস্কারের কথা শুনে কাজ কারবার ফেলে এখন শ্যামাপদকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে!”
“অ্যাঁ।”
“দু’গাড়ি পুলিশও এসে নামল একটু আগে। ওই উত্তর দিক থেকে তারা মার্চ করতে শুরু করেছে। যাকে সন্দেহ হচ্ছে তাকেই মারতে মারতে দারোগাবাবুর সামনে নিয়ে গিয়ে ফেলছে।”
নবকান্ত ভারী কাহিল বোধ করতে লাগল। অবশ হাতে ধরা বাক্সটা ভারী ঠেকছে। নবকান্ত লোকটার দিকে চেয়ে বলল, “মশাই, আমার একটা উপকার করতে পারেন?”
“বিলক্ষণ! উপকার করতে আমি খুব ভালবাসি।”
“আমার বড্ড জ্বর আসছে। এই বাক্সটা একটু গচ্ছিত রাখবেন? আমি গোবিন্দপুরের নবকান্ত রায়। দয়া করে যদি কখনও পৌঁছে দেন।”
লোকটা বলল, “এ আর বেশি কথা কী! আপনি রওনা হয়ে পড়ুন বাক্স ঠিক সময়মতো পৌঁছে যাবে।”
নবকান্ত আর দাঁড়াল না। তিরবেগে হাট ছাড়িয়ে মাঠে গিয়ে পড়ল। তারপর দৌড়।
.
শো শেষ হয়েছে, ভজহরির দুই শাগরেদ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। একটু বাদে তাঁবুটা গুটিয়ে নিয়ে রওনা দিলেই হয়। বাইরে গোরুর গাড়িও তৈরিই আছে।
একটা লম্বা-চওড়া লোক এসে ভজহরির সামনে দাঁড়াল। “ভজহরিবাবু, নমস্কার।”
ভজহরি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “আজ্ঞে, নমস্কার।”
“গঙ্গাধরপুরের কুমার বাহাদুর আজ আপনার খেলা দেখে খুব খুশি হয়েছেন।”
গঙ্গাধরপুর নামটা শুনেই ভজহরির বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা একটা লাফ মারল। অস্ফুট গলায় ভজহরি বলল, “গঙ্গাধরপুর!”
“যে আজ্ঞে। বহু বছর আগে আপনি গঙ্গাধরপুরের রাজবাড়িতে খেলা দেখিয়ে সবাইকে তাজ্জব করে দিয়েছিলেন, মনে আছে?”