“আজ্ঞে, না মহারাজ। এ-বাড়ি আমার রগে রগে চেনা।”
“যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। হঠাৎ করে গুপ্তধনটন বেরিয়ে পড়লে একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠবে হয়তো। বুড়ো বয়সে গুপ্তধনের ধকল কি আর আমার সইবে।”
“যে আজ্ঞে মহারাজ। মাঝে মাঝে আমারও মনে হয় গুপ্তধন জিনিসটা বোধ হয় খুবই খারাপ। টাকাপয়সা, সোনাদানা যদি গা ঢাকা দিতে থাকে তা হলে বড়ই অসুবিধে। খোলামেলা আলো হাওয়ায় থাকলে আমাদের মেহনত অনেক বেঁচে যেত। দেখছেন না রাজপুত্তুরের স্যাঙাতদের কেমন গলদঘর্ম হতে হচ্ছে!”
রাজা মহেন্দ্র একটু ভয়-খাওয়া গলায় বললেন, “তা ওরকম তেড়েফুঁড়ে খুঁজলে কিছু আবার বেরিয়ে পড়বে না তো হে শ্রীদাম? অত খোঁজাখুঁজি কি উচিত হচ্ছে?”
“আমিও তাই ভাবছি মহারাজ। যেরকম আদাজল খেয়ে লেগেছেন তাতে গুপ্তধনের কপালে কষ্ট আছে।”
“তাই তো হে। আমি ভাবছি কেঁচো খুঁড়তে আবার না সাপ বেরিয়ে পড়ে! তা ইয়ে, বাপু শ্রীদাম।”
“আজ্ঞা করুন মহারাজ।”
“একটা কথা ভাবছি।”
“কী কথা মহারাজ?”
“ইয়ে, তুমি কি ভূতটুতে বিশ্বাস কর?”
“বিশ্বাস না করলে ভূতেরা যে ভারী দুঃখ পান মহারাজ। দুঃখ পেলে তাঁদের ভারী অভিমান হয়, আর অভিমান হলে তাঁরা আর মুখ দেখান না। সেইজন্যই যারা ভূতে বিশ্বাস করে না তারা কখনও ভূত দেখতে পায় না।”
“তার মানে কী হল বাপু শ্রীদাম? তুমি কি বলতে চাও যে তুমি ভূত দেখেছ?”
“আপনার আশীর্বাদে তাঁদের সঙ্গে আমার বেশ দহরম মহরম।”
“বল কী হে?”
“আজ্ঞে, সকলের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় না রাখলে কি আমাদের কাজ কারবার চলে রাজামশাই? এই তো পরশুদিনই ফটিক হাজরার বাড়ির পশ্চিমের ঘরের দরজার কবজাটি খসিয়ে ঢুকতে গেছি, অমনি ফটিক হাজরার বুড়ি ঠাকুমার ভূত একেবারে করালবদনী কালীর চেহারায় এসে পথ আটকে দাঁড়াল। সে কী তড়পানি মহারাজ! তা সঙ্গে সঙ্গে সাষ্টাঙ্গে পেন্নাম করে পায়ের ধুলো নিয়ে বললুম, “ঠাকমা, ই কী চেহারা হয়েছে আপনার! শুকিয়ে যে আমসি হয়ে গেছেন! এঃ হেঃ, যমরাজার ডেরায় তো আপনার মোটেই যত্ন আত্তি হচ্ছে না। তাতে বুড়ি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আর বলিস না বাছা, সেখানে বড়ই অব্যবস্থা। এই বলে সাতকাহন দুঃখের কথা ফেঁদে বসল। তারপর নিজেই আমাকে সঙ্গে নিয়ে ফটিকের ঘরে কোথায় কী লুকোনো আছে দেখিয়ে দিল। তাই বলছিলুম মহারাজ, সকলের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় না রাখলে কি আমাদের চলে?”
“তা ইয়ে, বাপু শ্রীদাম, রাজবাড়িতেও তো তোমার খুব যাতায়াত, না কী বল!”
“যে আজ্ঞে।”
“তা এ-বাড়িতে কখনও কিছু দেখেছটেখেছ?”
“কী যে বলেন মহারাজ! এই তো ঢুকবার মুখেই লোচন দাদুর সঙ্গে দেখা। ভারী বেজার মুখে বিড়বিড় করে কাকে যেন শাপশাপান্ত করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। তা বললুম, ও লোচনখুড়ো, বলি বাক্সখানার হদিস পেলে? তা আমার দিকে কটমট করে চেয়ে বললেন, “ও বাক্স হজম করে এমন লোক এখনও জন্মায়নি, বুঝলি! ও বাক্স ফেরত আসবেই।”
রাজা মহেন্দ্র সটান হয়ে বসে বললেন, “বাক্স! কীসের বাক্স!”
“আজ্ঞে, লোচনখুড়ো পাগলছাগল মানুষ।কী বলেন তার ঠিক নেই। তবে অনেকদিন ধরেই একটা বাক্স খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তা মহারাজ, বাক্সের কথায় কি আপনি একটু চমকে উঠলেন?”
মহেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বাপু শ্রীদাম।”
“আজ্ঞা করুন মহারাজ।”
“তোমার সঙ্গে আমার একটু গুরুতর কথা আছে।”
“যে আজ্ঞে।”
“কথাটা না বললেই নয়। তাই বলছি।”