খুলে ভেতরে চলে গেলেন।”
“দরবার ঘরে যে ওরকম দরজাও নেই। নিরেট দেওয়াল দেখছেন না।”
“কিন্তু একটু আগেও যে ছিল! কী হল বলুন তো দরজাটার। খুব কারুকাজ করা একটা কাঠের দরজা।”
লোকটা কী আবোল তাবোল বকছে তার মাথামুন্ডু কিছুই মহেন্দ্র বুঝতে পারলেন না। তবে এটা মনে আছে, সবাই চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ফাঁকা দরবার ঘরে ভজহরি বজ্রাহতের মতো বসে ছিল। পরদিন সকালে আর তাকে দেখা যায়নি।
ঘটনাটা হঠাৎ মনে পড়ায় রাজা মহেন্দ্র মাঝরাতে উঠে বিছানায় ভূতগ্রস্তের মতো বসে রইলেন কিছুক্ষণ।
এই ঘটনার সঙ্গে কি ম্যাজিশিয়ান, বারো ধাপ আর ভূত ঘরের কোনও সম্পর্ক আছে? কিন্তু সম্পর্কটা কী হতে পারে তা মহেন্দ্র ভেবে পেলেন না। নাঃ, শ্রীদাম লোকটা যে কী বিদঘুঁটে কতগুলো কথা ঢুকিয়ে দিয়ে গেল মাথায়! কোনও মানেই হয় না। স্বপ্নটাই বা কেন দেখলেন কে জানে!
হঠাৎ চিড়িক করে একটা শব্দ হওয়ায় মহেন্দ্র চমকে উঠে চারদিকে চাইলেন। কোথায় শব্দটা হল তা বুঝতে না পেরে কান খাড়া করে রইলেন। ফের চমকে দিয়ে আবার চিড়িক শব্দ! মহেন্দ্র ভারী অবাক হচ্ছেন। এরকম শব্দ তো হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হচ্ছে। কোথায় হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। তিনবারের পর ফের চিড়িক শব্দ হওয়ায় মহেন্দ্র ‘বাপ রে’ বলে দু হাতে নিজের মাথাটা ধরলেন। শব্দটা হচ্ছে তাঁর মাথায়। সর্বনাশ! সন্ন্যাস রোগটোগ হল নাকি?
তিন চিড়িকের পর কিছুক্ষণ মাথা অন্ধকার হয়ে রইল। তারপর হঠাৎ ফস করে অন্ধকার মাথার মধ্যে একটা আলো জ্বলে উঠল। ঠিক যেন শেজবাতি। আর সেই আলোতে মহেন্দ্র দিব্যি পদ্মলোচনকে দেখতে পেলেন।
পদ্মলোচন ছিল রাজবাড়ির বহু পুরনো কাজের লোক। একশোর কাছাকাছি বয়স। সারা বাড়ি ভূতের মতো ঘুরে বেড়াত। সাদা চুল, সাদা দাড়ি-গোঁফ। সবসময়ে বিড়বিড় করে আপনমনে কথা কইত। লোকে বলত, খ্যাপা লোচন।
রাজা মহেন্দ্র দেখতে পেলেন, তিনি সেই কুড়ি-বাইশ বছর বয়সেই যেন ফিরে গেছেন। ঘরে শেজবাতি জ্বলছে। তিনি বিছানায় শোওয়া, আর পদ্মলোচন বাইরে থেকে তাঁর মশারি গুঁজে দিতে দিতে আপনমনে বকবক করে যাচ্ছে। প্রথমটায় কথাগুলো খেয়াল করছিলেন না মহেন্দ্র। হঠাৎ ম্যাজিকওয়ালা’ কথাটা কানে আসায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী বলছ লোচনদা?”
“ওই ম্যাজিকওয়ালার কথাই বলছি বাপু, অমন ভিরমি খাওয়ার কী হল তা বুঝি না। দরবার ঘরে তো তেনাদের নিত্যি আনাগোনা।”
মহেন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, “কাদের আনাগোনা?”
“ওই যে তেনারা, যাঁরা আসেন।”
“তাঁরা কারা লোচনদা?”
“তোমাদেরই পূর্বপুরুষরা ছাড়া আর কে হবেন?”
“অ্যাঁ! তুমি তাঁদের দেখতে পাও নাকি?”
“নিত্যি দেখছি। দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নামেন, পায়চারি করেন, চারদিকে ঘুরে সব দেখেন, সিঁড়ি বেয়ে উঠে যান।”
“দুর! কী যে বল! দরবার ঘরে সিঁড়ি কোথায়?”
“না থাকলে আছে কী করে?”
“তোমার যত গাঁজাখুরি গল্প।”
“গল্প কী গো! তেনাদের সঙ্গে যে আমার কথা হয়।”
মহেন্দ্ৰ হেসে ফেললেন, “কথাও হয়? তা কী বলেন তাঁরা?”
“কী আর বলবেন! আগের দিনকাল আর নেই বলে দুঃখটুঃখ করেন। তাঁরা লোকও বড্ড ভাল। গরিব দুঃখীদের জন্য প্রাণ কাঁদে। বুড়ো রাজা তো প্রায়ই জোর করেই আমার হাতে মোহর খুঁজে দেন। বলেন, ‘ওরে লোচন, কয়েকখানা মোহর নিয়ে কাছে রাখ। দুর্দিনে কাজে লাগবে।‘ তা আমি হাতজোড় করে বলি, না বাবা না, বয়স পাঁচ কুড়ি পেরোতে চলল, এখন মোহর দিয়ে কাজ কী? ‘তবু জোর করেই দেন।’”
মহেন্দ্র অবাক হয়ে বলেন, “তুমিও মোহর পেয়েছ?”
“জোর করে দিলে কী করব বলো!”
“তা মোহরগুলো তুমি কর কী?”
“কী আর করব। বাক্সে রেখে দিই।”
“বাক্স! তোমার আবার বাক্সপ্যাঁটরা ছিল কবে? কখনও তো দেখিনি!”
“আহা, আমার বাক্স আসবে কোত্থেকে? বুড়ো রাজাই বাক্স দিয়েছেন। ভারী সুন্দর বাহারি বাক্স। সেখানা রোজ রাতে মাথায় দিয়ে শুই।”
খ্যাপা লোচনের কথা কেউ বিশ্বাস করে না। মহেন্দ্রও করলেন না। পাগলের প্রলাপ মনে করে উড়িয়ে দিলেন।
হঠাৎ এতদিন পরে যেন ঘটনাগুলোর ভেতরে একটা অর্থ ভেসে উঠতে চাইছে, ঠিক যেমন ঘোলের মাথায় মাখন।
মহেন্দ্র একটু উত্তেজিত হয়ে টর্চবাতিটা নিয়ে খাট থেকে নামতে নামতে আপনমনেই বলে উঠলেন, “নাঃ, দরবার ঘরখানা ভাল করে দেখতে হচ্ছে।”
কে যেন খুব মোলায়েম গলায় বলে উঠল, “আজ্ঞে, কাজটা ঠিক হবে না।”
চমকে উঠে মহেন্দ্র বললেন, “কে?”
“আজ্ঞে, আমি শ্রীদাম খড়খড়ি।”
নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে মহেন্দ্র বললেন, “তাই বলো! তা এত রাতে কী মনে করে হে বাপু?”
“আজ্ঞে, আমার তো রাতবিরেতেই কাজ।”
“তাও তো বটে! খেয়াল ছিল না। তা কী বলছিলে যেন?”
“আজ্ঞে, বলছি এখন দরবার ঘরে যাওয়াটা আপনার ঠিক হবে না।”
“কেন বলো তো বাপু?”
“আজ্ঞে, ওনারা সব রয়েছেন কিনা!”
আঁতকে উঠে রাজা মহেন্দ্র বললেন, “কারা?”
“আজ্ঞে, রাজকুমার নবেন্দ্রর চেলাচামুণ্ডারা।”
“অ্যাাঁ, তা তারা এত রাতে কী করছে সেখানে?”
“রোজ যা করেন।”
“রোজ কী করে তারা?”
“কী যেন খোঁজেন।”
“কী খোঁজেন বলল তো!”
“গুপ্তধনটনই হবে বোধ হয়। কে আর জিজ্ঞেস করতে গেছে। বলুন। কার ঘাড়ে ক’টা মাথা!”
“তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু এ তো বড় চিন্তার কথা হল। তোমার কি মনে হয় এ বাড়িতে গুপ্তধন আছে?”