শ্রীদাম চোখ বড় বড় করে বলল, “তবে যে শুনেছিলুম মহারাজ, আপনি চোখে কম দেখেন!”
“দেখিই তো! চোখে কম দেখি, কানে কম শুনি। এই যে তুমি সামনে দাঁড়িয়ে আছ, এই তোমাকেই ঠিকমতো ঠাহর হচ্ছে না। একবার মনে হচ্ছে আছো, একবার মনে হচ্ছে নেই।”
গদগদ স্বরে শ্রীদাম বলে, “এরকম কম দেখলেই হবে মহারাজ। এখন থেকে এরকম কমই দেখতে থাকুন।”
মহেন্দ্র একটু তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, “তা বাপু শ্রীদাম।”
“যে আজ্ঞে।”
“তুমি যেন বলেছিলে জডুলটা যথাস্থানেই আছে। ঠিক শুনেছিলুম তো?”
“আজ্ঞে ঠিকই শুনেছেন।”
“তা হলে কি ধরে নেব যে, তুমি জডুলটার সন্ধান জান?”
“আমার যা কাজ তাতে সুলুকসন্ধান না রাখলে কি চলে মহারাজ?”
“তা তো বটেই, তা বলছিলুম কি, সুলুকসন্ধান দিতে কত মজুরি চাও?”
নিজের দুটো কান ধরে শ্রীদাম বলে, “ছিঃ ছিঃ মহারাজ, মজুরির কথা ওঠে কীসে? রাজবাড়ির নুন কি কম খেয়েছি?”
“ভাল, ভাল, মজুরি চাইলেও দিতে পারতুম না কিনা, তা হলে সুলুকসন্ধানটা কি বিনি মাগনাতেই দেবে?”
শ্রীদাম বুকটা চিতিয়ে বলে, “মহারাজ, রাজার জন্য প্রজা না পারে কী? প্রয়োজন হলে প্রাণটা পর্যন্ত পিরিচে করে এনে পায়ে নিবেদন করতে পারে।”
“বাঃ বাঃ, শুনে বড় খুশি হলুম।”
শ্রীদাম এবার একটু মাথা চুলকে বলে, “তবে মহারাজ, একটা কথা আছে।”
“কী কথা হে বাপু?”
“জানাজানি হলে জডুলের কিন্তু প্রাণসংশয় হবে। যার জডুল নেই সে জডুলওলাকে খুঁজে বেড়াবেই। পেলেই ধড় মুন্ডু আলাদা করবে। মুন্ডু না থাকলে জডুলের আর দাম কী বলুন।”
মহেন্দ্র চমকে উঠে বললেন, “থাক, থাক, আর বলতে হবে না। জডুল যথাস্থানে থাকলেই হল।”
বিগলিত হেসে হাতটাত কচলে শ্রীদাম বলল, “আজ্ঞে, যথাস্থানের জডুলের হুকুমেই আপনার শ্রীচরণ দর্শনে আসা আমার।”
রাজা মহেন্দ্র হঠাৎ বার্ধক্য ঝেড়ে পটাং করে সোজা হয়ে বড় বড় চোখে চেয়ে বললেন, “বল কী!”
“আজ্ঞে, আমি যেখান থেকে আসছি সেখানে যথাস্থানে জড়ল আছেই, সেইসঙ্গে ডান হাঁটুতে ফোড়া কাটার দাগ, ডান কনুইতে আঁচিল, চিলের আঁচড় সব পাবেন।”
“আমার যে বুক ধড়ফড় করছে শ্রীদাম!”
“তা করে একটু করুক মহারাজ, ধড়ফড়ানিটা কমলে বলবেন। বাকিটা বলব। আমি বসছি।”
“না, না, বলো।”
“যে আজ্ঞে, আমার ওপর হুকুম হয়েছে আপনাকে তিনটে কথা বলে যেতে।”
“বলে ফেলো শ্রীদাম, বলে ফেলল।”
“কথাগুলো হচ্ছে ম্যাজিশিয়ান, বারো ধাপ, ভূত ঘর, কিছু বুঝতে পারলেন মহারাজ?”
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু। আরবি, ফারসি নয়
তো?”
“আজ্ঞে, নিতান্ত বাংলা কথাই তো মনে হচ্ছে।”
“এর মানে কী?”
“তা তো জানি না মহারাজ। কথাগুলো আপনি মনে মনে একটু নাড়াচাড়া করুন। মনে হয় কিছু একটা বেরিয়ে পড়বে।”
ঠিক এই সময়ে হঠাৎ ছাদের দরজায় বিভীষণের মতো চেহারার একটা লোকের আবির্ভাব হল। বাজডাকা গলায় লোকটা পিলে চমকানো হুংকার ছাড়ল, “অ্যাই, তুই কে রে? এখানে কী মতলবে?”
দেখা গেল শ্রীদাম রোগাভোগা মানুষ হলেও খুব ঠান্ডা মাথার লোক। একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে তাড়াতাড়ি জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে একগাল হেসে বলল, “সনাতনদাদা যে! প্রাতঃ পেন্নাম! প্রাতঃ পেন্নাম!”
লোকটা যমদূতের মতো সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভাঁটার মতো চোখে শ্রীদামকে মাথা থেকে পা অবধি দেখে নিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “তোকে কে বলেছে যে আমার নাম সনাতন?”
ভারী অবাক হয়ে শ্রীদাম বলল, “সনাতন নয়! এঃ হেঃ!? তা হলে তো বড় ভুল হয়ে গেছে মশাই! আমি যেন কেমন সনাতন সনাতন গন্ধ পেলাম!”
“এ বাড়িতে কেন ঢুকেছিস?”
শ্রীদাম ভালমানুষটির মতো বলে, “ঢাকাটা কি ভুল হয়েছে মশাই? তা হলে না হয় বেরিয়ে যাচ্ছি।”
“বেরোনো অত সোজা নয়!” বলেই ভয়ংকর লোকটা হাত বাড়িয়ে শ্রীদামের ঘাড়টা ক্যাঁক করে ধরে ফেলল। রাজা মহেন্দ্র অবাক হয়ে দেখলেন, বিভীষণটা শ্রীদামের ঘাড়টা ধরল বটে, আবার যেন ধরলও না! শ্রীদাম ভারী বিনয়ের সঙ্গে ঘাড়সুষ্ঠু মাথাটা কেমন করে যেন লহমায় সরিয়ে নিল।
সনাতন খুব অবাক হয়ে শ্রীদামের দিকে চেয়ে “তবে রে” বলে থাবড়া তুলে এগিয়ে যেতেই শ্রীদাম বলে উঠল, “মারবেন না মশাই, মারবেন না। আমার বড্ড নরম শরীর। মারলে বড় লাগে।”
সনাতন নামক দৈত্যটা বিদ্যুৎগতিতে গিয়ে শ্রীদামের ওপর এমনভাবে পড়ল যে, শ্রীদামের পিষে যাওয়ার কথা। রাজা মহেন্দ্র ভয়ে চোখ বুজে ফেললেন। চোখ চেয়ে দেখেন, বিভীষণটা গদাম করে ছাদের ওপর পড়ে গেল। তারপর “বাবা রে, মা রে” বলে আছাড়িপিছাড়ি খেতে লাগল। শ্রীদাম ছাদের কার্নিশের ধার থেকে মহেন্দ্রকে একটা পেন্নাম করে বলল, “তা হলে আজ আসি রাজামশাই, মাঝে মাঝে শ্রীচরণ দর্শনে চলে আসব’খন, ভাববেন না,” বলেই রেলিং টপকে নেমে গেল।
মহেন্দ্র একটা ভারী আরামের শ্বাস ছাড়লেন। দুদ্দাড় করে বাড়ি কাঁপিয়ে দৈত্য দানোর মতো নবেন্দ্রর স্যাঙাতরা সব ছাদে এসে হাজির। তারপর তুমুল চেঁচামেচি, “কে মারল সনাতনকে! কার ঘাড়ে ক’টা মাথা, কার এত আম্পদ্ধা! আজ রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব। তার মুন্ডু নিয়ে পান্তুয়া খাব। বুকের পাটা থাকে তত বেরিয়ে আয় ব্যাটা!”
রাজপুত্র নবেন্দ্র গম্ভীর মুখে মহেন্দ্রর সামনে এসে দাঁড়াল, “এসব কী বাবা!”
মহেন্দ্র জুলজুল করে নবেন্দ্রর দিকে চেয়ে বললেন, “হ্যাঁ, কী একটা চেঁচামেচি হল যেন শুনলাম, কানে ভাল শুনতে পাই না তো! কী ব্যাপার বলো তো বাবা! এত হুলুস্থুলু কীসের?”