হলে যে অন্যটা ফুটে ওঠে না।”
“সে তো ঠিক কথাই হে শ্রীদাম।”
“তাই বলছিলাম, আমার মতো মনিষ্যির কিছু দরকার আছে বলেই এই অধমের সৃষ্টি হয়েছিল।”
“তা তুমি পুলিশ না চোর?”
“চোর বললে কি আপনি রাগ করবেন?”
“না হে বাপু, না, রাগ করব কেন? পরিশ্রম করে উপায় করা কি খারাপ? তা বলে বাপু, এ বাড়িতে কিন্তু সুবিধে হবে না তোমার।”
হাত কচলে শ্রীদাম বলে, “তা আর বলতে! এ বাড়িতে চোরের একাদশী, একসময়ে কত ঘটিটা বাটিটা সরিয়েছি। সেসব কথা ভাবতেও চোখে জল আসতে চায়। আহা, কী দিনকালই ছিল, রাজপুত্তুররা মোহর দিয়ে ঢিল মেরে মেরে আম পাড়ত। রাজবাড়ির কুকুরের গলায় বকলসের বদলে থাকত নেকলেস। পোলাও কালিয়া ছাড়া কাঙালি ভোজন হত না।”
“উঁহু উঁহু, অতটা বলার দরকার নেই। আর একটু চেপেচুপে বললেই হবে। তা হলে জডুলের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বলছ?”
“যে আজ্ঞে। একটু তলিয়ে ভাবুন। কাল আমি আবার এসে হাজির হব’খন। রাজকুমারের স্যাঙাত বাবাসকলের ঘুম ভাঙার সময় হয়েছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না।”
রাজামশাই খুবই চিন্তিতভাবে জডুলের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগলেন। রাতে খেতে বসে রানিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা ইয়ে, তা নবেন্দ্রর বাঁ বগলের নীচে নাকি একটা লাল জজুল ছিল? আমি অবশ্য বিশ্বাস করিনি কথাটা। তা ছিল নাকি?”
রানি বললেন, “ও মা! বিশ্বাস না করার কী? আমার নবেনের বাঁ বগলের নীচে লাল জঙুল তো ছিলই। কেমন বাপ গো তুমি যে, ছেলের জডুলের কথা মনে রাখতে পার না?”
“তা বটে! মনে রাখাটা উচিতই ছিল। তা সেই জডুল নিয়েই একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। জডুলটা কি যথাস্থানে নেই। না মানে
যথাস্থানেই আছে, তবে আবার নাকি নেইও। আবার নাকি আছেও। ভারী গোলমেলে ব্যাপার। শ্রীদাম বলছিল বটে।”
“শ্রীদামটা আবার কে?”
“তার কথা আর বোলা না, সে একটা চোর। তবে লোকটা ভালই।”
“চোরও বলছ, আবার ভাল লোকও মনে হচ্ছে তাকে?”
“আহা, চোরদের মধ্যে কি ভাল লোক নেই! খুঁজলে বিস্তর পাওয়া যাবে।”
রানিমা ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “তবে কথাটা খুব মিথ্যে নয়। নবেনের বাঁ বগলের নীচে জঙুল নেই।”
“নেই! যাক, বাঁচা গেল। আমিও ভাবনায় পড়েছিলাম। তা জডুলটা গেল কোথায় বলো তো! ডান বগলের নীচে নাকি?”
“জজুল কি জায়গা বদল করে?”
“তা হলে?”
রানিমা একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “মনে হয় ঘামাচিটামাচি চুলকোতে গিয়ে জডুলটা উঠে গেছে।”
“তা হলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল।”
রানিমা হঠাৎ চোখ পাকিয়ে বললেন, “তুমি কি ভাবছ জডুল নেই বলে এ আমার নবেন নয়?”
“তাই বললুম নাকি? রামোঃ, একথা আমার মাথাতেই আসেনি, নবেন নয় মানে? আলবত নবেন। ওর ঘাড়ে ক’টা মাথা যে নবেন না হবে?”
“তাই বলো! আমি কিন্তু দেখেই চিনেছি। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই দুষ্টু দুষ্টু ভাব। আহা, এখনও সেই এটা খাব-ওটা খাব বলে বায়না।”
বলে রানি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
মহেন্দ্র বললেন, “জডুলটা তা হলে ওই ঘামাচির সঙ্গেই উঠে গেছে বলছ!”
“কেন, ওরকম কি হতে নেই?”
“তা হবে না কেন? হতেই পারে। জঙুল তো দেখছি নিতান্তই ফঙ্গবেনে জিনিস।”
“জল নিয়ে আর মাথা গরম কোরো না তো! এতবড় ছেলেটাকে আস্ত ফেরত পেলে, তাতে গাল উঠছে না নাকি? জডুলটা ফেরত আসেনি তো কী হয়েছে? ছেলে বেশি, না জডুল বেশি?
“আহা, ছেলের সঙ্গে জডুলের কি তুলনা হয়? ওসব নয় রানি, ভাবছি চোরটা এলে তাকে কী বলব! জডুলটা আছে, না নেই?”
“চোরছ্যাঁচড়ার সঙ্গে অত মেলামেশার তোমার দরকার কী?”
“চোর হলেও সে আমার প্রজা, সন্তানবৎ। বুঝলে না! থাকগে, জতুল নিয়ে তা হলে আর মাথা ঘামাচ্ছি না।”
“একদম না। নবেন ফিরে এসেছে, সেই আমার ঢের। জডুল চুলোয় যাক।”
পরদিন দুপুরবেলা একগাল হাসি নিয়ে শ্রীদাম এসে প্রণাম করে সামনে দাঁড়াল।
রাজা মহেন্দ্র তাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, “ওহে, বোসো, বোসো৷”
“তলিয়ে ভাবলেন নাকি মহারাজ?”
“তা আর ভাবিনি! যা একখানা সমস্যা ঢুকিয়ে দিয়ে গেলে মাথায় যে, আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। তোমাদের রানিমার সঙ্গে কথা হল। তা বুঝলে বাপু, জডুলটা নাকি ঘামাচি চুলকোতে গিয়ে উঠে গেছে।”
“যে আজ্ঞে।”
“সেরকম কি হয় না?”
“আজ্ঞে, রাজা-রাজড়াদের ঘরে কী না হয় বলুন! সবই হতে পারে। তবে রাজামশাই, আপনি আরও একটু তলিয়ে ভাবলে জড়ুলের একেবারে গোড়ায় যেতে পারবেন।”
“জডুলের গোড়ায়? সেখানে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?”
“আজ্ঞে, না গেলেই যে নয়!”
“কেন বলো তো?”
“ওখানেই সব রহস্য ঘাপটি মেরে আছে।”
“হুঁ, তা তোমার রানিমা অবশ্য বলেছিলেন ছেলে বেশি না জডুল বেশি। উনি দেখলুম জডুলের বিশেষ ভক্ত নন।”
“আজ্ঞে। তবে কিনা জডুল বাদ দিলে রাজকুমারের যে আর কিছুই থাকে না।”
“আচ্ছা, শ্রীদাম, তোমার কি সন্দেহ হচ্ছে এ-ছেলেটা আমাদের নবেন নয়?”
শ্রীদাম জিভ কেটে বলল, “আরে ছিঃ ছিঃ! উনি যখন বলছেন উনিই নবেন, তখন নবেন ছাড়া আর কে হবেন?”
“আমারও সেই কথা। নবেন যখন বলছে সে নবেন, তখন আমাদের আপত্তি করার কী আছে? কী বল?”
ঘন ঘন দু’ধারে মাথা নেড়ে শ্রীদাম বলে, “আমারও আপত্তি হচ্ছে না মহারাজ। নবেন হতে বাধা কী? যে কেউ নবেন হতে পারে!”
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “পারেই তো। জডুলটা ফেরত আসেনি তো কী হয়েছে?নবেন তো ফিরেছে! আর শুধু জঙুলই বা কেন, নবেনের ডান হাঁটুতে একটা ফোড়া কাটার দাগ ছিল, সেটা ফেরত আসেনি। ডান হাতের কনুইয়ের কাছে একটা আঁচিল ছিল, সেটাও ফেরত আসেনি। একবার চিল ছোঁ মেরে হাত থেকে রসগোল্লা নিয়ে যাওয়ার সময় নবেনের কপালে আঁচড় দিয়ে গিয়েছিল, সেই দাগটাও ফেরত আসেনি। তা ওসব তুচ্ছ জিনিসের জন্য কি আমাদের দুঃখ করা উচিত! নবেন যে ফিরেছে এই ঢের।”