“আমি পা দাবাতে আসিনি মহারাজ।”
মহেন্দ্র সন্দিহান হয়ে বললেন, “তবে কি গুপ্তধন?”
“আজ্ঞে না। আমি রাজকুমারের দলের লোক নই।” নিশ্চিন্তির খাস ছেড়ে মহেন্দ্র বললেন, “বাঁচালে বাবা। তা তুমি কে?”
“অধমের নাম শ্রীদাম খড়খড়ি।”
“কী চাও বাপু?”
“আজ্ঞে, একটু কথা ছিল। অনেকদিন ধরেই সুযোগ খুঁজছি। তা কুমার বাহাদুরের লেঠেলদের দাপটে রাজবাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারিনি। তা দেখলুম দুপুরের দিকে তেনারা খেয়েদেয়ে একটু ঘুমোন। ঘুমেরও দোষ নেই। আজই পদ্মলোচনবাবুর পুরুষ্টু পাঁঠাটা নিয়ে এসে কেটে খেয়েছেন তো! গুরুভোজনের পর ঘুম তো আসবেই।”
“পদ্মলোচনের পাঁঠা! বল কী হে? সে যে ভয়ংকর রাগী আর মারমুখো লোক!”
“তাই ছিলেন। তবে এখন তাঁর পাকানো গোঁফ ঝুলে পড়েছে। রক্ত জল করা চাউনি ঘোলাটে মেরে গেছে, উঁচু গলায় কথাটি কন না। আর তা হবে না-ই বা কেন বলুন! কুমার বাহাদুরের লোকেরা যে তাঁকে তাঁর ছেলেপুলে, নাতিপুতির সামনেই পঞ্চাশবার কান ধরে ওঠবোস করিয়েছে!”
“বল কী?”
“আজ্ঞে, এইসব বৃত্তান্ত শোনাতেই আসা।”
সভয়ে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে মহেন্দ্র বললেন, “বৃত্তান্ত আরও আছে নাকি?”
“বিস্তর মহারাজ। বিস্তর। বলতে গেলে মহাভারত।”
মহেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “না, গতিক সুবিধের নয়।”
“মহারাজ, যদি আম্পদ্দা বলে না ধরেন তা হলে শ্রীচরণে দুটো কথা নিবেদন করি।”
“বলে ফেলো বাপু।”
“রাজকুমার নরেন্দ্রর বাঁ বগলের নীচে একটা লাল জডুল ছিল।” মহেন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, “ছিল নাকি?”
“আজ্ঞে। এই অধমের আর কিছু না থাক, ভগবানদত্ত দু’খানা চোখ আছে। রাজকুমার যখন ছোটটি ছিলেন তখন কোলেপিঠেও করেছি কিনা।”
“অ। তা জডুলের কথাটা উঠছে কেন?” মাথা চুলকে ভারী লাজুক মুখে শ্রীদাম বলল, “আজ্ঞে, জডুলটা এখন আর নেই।”
মহেন্দ্র সটান হয়ে বসে বললেন, “নেই! তা হলে সেটা গেল কোথায়?”
“আজ্ঞে, জডুল যথাস্থানে আছে।”
“এ তো বড় গোলমেলে কথা বাপু। একবার বললে জডুল ছিল, একবার বললে নেই, ফের বললে জডুল যথাস্থানে আছে! তা হলে মানেটা কী দাঁড়াল?”
“ব্যাপারটা যেমন গোলমেলে, তেমনই আবার জলের মতো সোজা। জডুলটা যথাস্থানে আছে মানে হল, সেটা অস্থানে নেই।”
“তা বাপু, জডুলটা ওরকম লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে কেন? এক জায়গায় গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলেই তো হয়!”
“জডুলকে দোষ দেবেন না মহারাজ। জডুলরা লাফালাফি করতে মোটেই পছন্দ করে না। যে জায়গায় থাকার, জতুল সেখানেই গ্যাঁট হয়ে বসে আছে।”
“তা হলে যে বললে ‘নেই’?”
“শুধু ‘নেই’ বলিনি মহারাজ, সেইসঙ্গে ‘আছে’ও বলেছি।”
“ব্যাপারটা তো তা হলে আরও জটিল হয়ে উঠল হে!”
“যে আজ্ঞে জজুল ব্যাপারটা খুবই জটিল। তবু যদি মহারাজ অভয় দেন তো বলি, রাজকুমার যখন ছোটটি ছিলেন তখন তাঁর বাঁ বগলের নীচে লাল একটা জডুল ছিল। যখন দিব্যি লম্বাচওড়া হয়ে আপনার কোলে ফিরে এয়েছেন তখন তাঁর বাঁ বগলের নীচে জডুলটার চিহ্নমাত্র নেই। এটা কী করে হয় একটু ভেবে দেখেছেন?”
রাজা মহেন্দ্র খুবই ভাবিত হয়ে বললেন, “তাই তো হে! এ তো বেশ সমস্যাঁতেই পড়া গেল দেখছি! তুমি কি বলতে চাও জডুলটা বাঁ বগলের নীচে থেকে ডান বগলের নীচে সরে গেছে?”
“না মহারাজ, সেটা বাঁ বগলের নীচেই আছে।” রাজা মহেন্দ্র হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু, জডুলটার মতিগতি আমি ভাল বুঝছি না।”
“একটু তলিয়ে ভাবুন মহারাজ, তা হলেই বুঝবেন।”
“ওরে বাপু, অত ভাবাভাবির কী আছে! বুঝিয়ে বললেই তো হয়।”
“আজ্ঞে, ফাঁদালো করে বলতে ভরসা হয় না মহারাজ। ঘাড়ে তো একখানা বই মাথা নেই। তাই টাপেটোপে বলছি।”
“কেন বাপু, ভেঙে বলতে দোষ কী?”
“গর্দান যেতে পারে। আপনিও কুপিত হতে পারেন।”
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “ওরে বাপু, আমি গর্দান টর্দান নিতে মোটেই পছন্দ করি না। বুড়ো বয়সে ঘটিবাটি তুলতেই মাজায় ব্যথা হয় তায় খাঁড়া। নির্ভয়ে বলো বাপু শ্রীদাম। জডুলটা বাঁ বগলে ছিল, এখন সেটা সেখানে নেই– এই তো?”
“যে আজ্ঞে।”
“আবার দেখা যাচ্ছে, যেখানকার জডুল সেখানেই আছে এই
তো?”
একগাল হেসে শ্রীদাম বলল, “এইবার বুঝেছেন। চেপে একটু ভাবলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে এবার।”
“তা বাপু, তুমি জডুলটা সম্পর্কে এত জানলে কী করে? বলি তোমার কি জডুলেরই কারবার নাকি?”
“আজ্ঞে না মহারাজ, আমার অন্যদিকে একটু হাতযশ আছে।”
“তা বাপু, জডুলের কারবারও কিছু খারাপ ছিল না। ধাঁ করে উন্নতি করে ফেলতে পারতে। তা তোমার হাতযশটা তা হলে কোন দিকে।”
মাথা নিচু করে শ্রীদাম ঘাড়টাড় চুলকে লজ্জার হাসি হেসে বলল, “আপনি দেশের রাজা, একরকম বাপের মতোই, কী বলেন!”
“অবশ্য, অবশ্য।”
“আগে দেশে কোটাল ছিল, কনিষ্ঠবল ছিল। আজকাল সে জায়গায় দারোগা এয়েছে, কনেস্টবল এয়েছে, ঠিক কিনা?”
“খুব ঠিক।”
“তা তারা কীজন্য এয়েছে বলুন?”
“তারা চোর-ডাকাত ধরতেই এসেছে।”
“তবেই দেখুন, চোর-ডাকাত ছাড়া দারোগা-পুলিশের চলে না, ঠিক তো!”
“খুব ঠিক।”
“আজ্ঞে, আমার তো মনে হয়, চোর-ডাকাত না থাকলে দেশটা যেন কানা হয়ে যায়। ভগবানের রাজ্যে সবাইকেই তো দরকার নাকি? বেড়ালকেও দরকার, ইঁদুরকেও দরকার, বাঘকেও দরকার, ছাগলকেও দরকার, সাদাকেও দরকার, কালোকেও দরকার, একটা