লোকটা একগাল হেসে বলল, “বাবা, আমাকে চিনতে পারলে না? আমি যে তোমার নবেন্দ্র!”
নবেন্দ্র! মহেন্দ্র হাঁ হয়ে গেলেন! দশ বারো বছর আগে নবেন্দ্রর দশ-বারো বছর বয়স ছিল। এখন সে এত লম্বাচওড়া হয়েছে যে, চেনার উপায় নেই। তা ছাড়া মহেন্দ্র চোখেও কম দেখেন।
খবর পেয়ে রানিমা ধেয়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না, “কোথায় ছিলি বাপ, এতকাল মাকে ছেড়ে! এতদিনে বুড়ো মা বাবার কথা মনে পড়ল? ওরে তোরা শাঁখ বাজা, উলু দে…”
কিন্তু শাঁখ বাজানো বা উলু দেওয়ার মতো লোকই তো নেই রাজবাড়িতে! বুড়ি দাসী সুবালাই মস্ত শাঁখখানা নিয়ে বিস্তর ফুঁ দিল বটে, কিন্তু দম নেই বলে আওয়াজ বেরোল না।
রানিমা বাজারে তোক পাঠিয়ে রাজকীয় ভোজের আয়োজন করলেন। তারপর সোনার থালা, রুপোর বাটি বের করারও হুকুম হল। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, সেসব কিছুই আর রাজবাড়িতে নেই। বহুকাল আগেই বিক্রিটিক্রি হয়ে গেছে।
আয়োজনের খামতি হলেও আনন্দের তেমন খামতি হল না। পাড়াসুদ্ধ লোক ঝেটিয়ে এসে রাজকুমারকে দেখে গেল। বুড়ো পুরুত থুতনি নেড়ে রাজকুমার নবেন্দ্রকে আদর করে বললেন, “সেই মুখ! সেই চোখ! কতটুকু দেখেছি!”
নবেন্দ্র যে অভাবী মানুষ নয়, তা তাকে দেখেই বোঝা যায়। আঙুলে দামি আংটি, হাতে দামি ঘড়ি, গলায় সোনার চেন, পকেটে টাকা, জামাকাপড় রীতিমতো ভাল। মুখে মিষ্টি হাসি আর বিনয়ী ব্যবহার।
ছেলে কেষ্টবিষ্ট হয়ে ফিরেছে মনে করে রাজা মহেন্দ্র আশায় বুক বাঁধলেন। আজকাল ভাতের পাতে ডাল, ভাত আর ঘ্যাঁট ছাড়া বিশেষ কিছু জোটে না, দুধটুকু পর্যন্ত হিসেব করে খেতে হয়। বাজারে মেলা ধার বাকি। মহারানি ছেঁড়া শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বেতন না পেয়ে নায়েব, গোমস্তা, চাকরবাকর সব বিদেয় নিয়েছে। রাজবাড়ির বড়ই দুর্দশা। ছেলে যদি এবার সুখের মুখ দেখায়!
তা পরের দিন সকালেই সুখের মুখ দেখে ফেললেন মহেন্দ্র। সিংহাসনে বসে সবে তন্দ্রাটি এসেছে, তাঁর ছেলের দুই ষণ্ডামার্কা স্যাঙাত এসে তাঁর দুই পা দাবাতে বসে গেল। মহেন্দ্ৰ আঁতকে “বাবা রে” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।
বিগলিত হাসি হেসে তারা বলল, “লাগল নাকি রাজামশাই?”
মহেন্দ্ৰ আতঙ্কিত হয়ে বললেন, “বুড়ো বয়সের হাড়, ভেঙে যাবে যে!”
“তা বলে কি পদসেবা করব না রাজামশাই! আমাদের ওপর হুকুম আছে যে!”
“অ। তা হুকুম থাকলে কী আর করা! কিন্তু বাপু, অভ্যেস নেই যে, ওসব পদসেবাটেবা কি আমার সইবে?”
“উপায় নেই রাজামশাই, পদসেবা না করলে আমাদের গর্দান যাবে। কুমার বাহাদুর আপনার মতোই তেজি পুরুষ, বেয়াদবি একদম পছন্দ করেন না।”
“ওরে বাবা! তা হলে বরং হাতে একটু তেল মেখে নাও বাবারা, তোমাদের হাত যে শিরীষ কাগজের মতো খরখর করছে!”
“আজ্ঞে, সে চেষ্টা কি আর করিনি! রানিমার কাছে তেল চাইতে গিয়েছিলাম। তা তিনি তেল শুনে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।”
মহেন্দ্র হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রইলেন। দুই ষণ্ডা তাঁর পদসেবা করেই ছাড়ল না, পা ছেড়ে হাতে উঠল, হাত ছেড়ে কাঁধে, তারপর মাথাতেও বিস্তর তবলাটবলা বাজিয়ে যখন ক্ষান্ত হল তখন মহেন্দ্র নেতিয়ে পড়েছেন। দুদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেননি।
তৃতীয় দিন সিংহাসনে গিয়ে বসতে না বসতেই আঁতকে উঠে দেখলেন, দুই ষণ্ডা আবার এসে হাজির। প্রাণের মায়া ছেড়েই দিয়েছেন মহেন্দ্র। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ষণ্ডারা পা দাবাতে দাবাতে বলল, “তা রাজামশাই, রাজবাড়ির পেছনের পুকুরটা কি আপনার নয়? সকালে জাল নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম, তা তিন-চারটে লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে তেড়ে এল। শুনলুম তারা নাকি পুকুর ইজারা নিয়েছে। সত্যি নাকি?”
“হ্যাঁ বাবারা, হলধর দাসের কাছে ইজারা দেওয়া আছে বটে।”
“তাই বলুন। তা আমরা অনেক কাকুতিমিনতি করলুম যে, একখানা পাঁচ-সাতসেরি রুইমাছ হলেই আমাদের চলবে। রাজবাড়িতে নজরানা দেওয়ারও তো একটা নিয়ম আছে, নাকি বলুন। তা কিছুতেই রাজি হয় না। তাই তখন মোলায়েম করে দু-চারটে রদ্দা মারতেই হল।”
“মারধর করেছ! সর্বনাশ! থানাপুলিশ হবে যে!”
“না, সে ভয় নেই। তারা লক্ষ্মী ছেলের মতো যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে-বসে আছে। কেউ থানামুখো হয়নি।”
শঙ্কিত হয়ে মহেন্দ্র বললেন, “মাছও ধরলে নাকি?”
“ওই একখানা দশসেরি রুই মোটে ধরা হয়েছে।”
পরের দিন ফের পা দাবাতে বসে ষণ্ডারা বলল, “আচ্ছা রাজামশাই, রাজবাড়িতে চোরা কুঠুরিটুরি নেই?”
“না হে বাপু। ছিল কিছু। সব ধসে গেছে।”
“দেওয়ালেটেওয়ালে কোথাও লুকোনো সিন্দুকটিক?”
“না বাবারা। সেসব কিছু নেই।”
“আর সোনা-রুপোর বাসনটাসনগুলো?”
মহেন্দ্ৰ হাত উলটে বললেন, “সেসব কবে বিক্রিবাটা হয়ে গেছে। তা বাবারা, এসব জানতে চাইছ কেন?”
“আজ্ঞে, সাবধান হওয়ার জন্যই জেনে নিচ্ছি। চারদিকে যা চোরছ্যাঁচড়ের উৎপাত! জিনিসপত্রের একটা হিসেব থাকা ভাল।”
মহেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গতিক তাঁর সুবিধের ঠেকছে না।
একদিন রাজা মহেন্দ্র দুপুরবেলা ছাদে বসে রোদ পোয়াচ্ছেন। এমন সময়ে ভারী জড়োসড়ো হয়ে একটা লোক তাঁর সামনে এসে পেন্নাম করে দাঁড়াল।
মহেন্দ্ৰ আঁতকে উঠে বললেন, “না, না বাবা! এখন আমার পা দাবানোর দরকার নেই। সকালেই হয়ে গেছে।”