নোকটা বেশ গলা তুলেই কথা কইছে, ফলে আশপাশের লোক ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। নবকান্ত প্রমাদ গুনল।
লোকটা খুব গ্যাল গ্যাল করে হেসে বলে, “তোমার নজর বরাবরই উঁচু। ছোটখাটো কাজ করার লোক তুমি নও। মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। তা আস্ত একখানা ক্যাশবাক্সই যদি লুট করলে তবে গোরা ময়রার বোঁদে কেন? শেফালি কেবিনের মোগলাই পরোটা আর কষা মাংস কী দোষ করল হে শ্যামাপদ?”
“আমি শ্যামাপদ নই, আপনি ভুল করছেন।”
“আহা, এই পরিস্থিতিতে যে নামধাম পালটে ফেলতে হয়, তা কি আর আমি জানি না? তা নতুন নামটা কী নিলে হে? বেশ ভাল দেখে একটা নাম নিয়েছ তো!”
নবকান্ত বুঝতে পারছিল, আর দেরি করা ঠিক হবে না। বোঁদের দামটা টেবিলে রেখে সে টক করে উঠে পড়ল।
“চললে নাকি হে শ্যামাপদ? তা এসো গিয়ে। সব ভাল যার শেষ ভাল।”
নবকান্ত বেরিয়ে হনহন করে হাঁটা দিল।
৫. রাজা মহেন্দ্র সিংহাসনে বসে
সকালবেলাটায় রাজা মহেন্দ্র সিংহাসনে বসে ঘুমোচ্ছিলেন। বুড়ো বয়সের ওইটাই দোষ। যখন-তখন ঘুম পেয়ে যায়। সিংহাসনটার অবস্থা অবশ্য খুবই খারাপ। কাঠের ওপর পেতলের পাত লাগানো ছিল। সেগুলো পুরনো হয়ে উঠে যাচ্ছে, গদির ছোবড়া বেরিয়ে পড়েছে। ছারপোকার উপদ্রবও আছে খুব। বসলে মোটেই আরাম হয় না, বরং অসাবধান হলে ভাঙা পেতলের পাতে কিংবা উঠে-থাকা পেরেকে খোঁচা লাগে, গদির ছোবড়া কুটকুট। করে। তবু মহেন্দ্র বেশ আরাম করে গুটিসুটি হয়ে বসে রোজই ঘুমিয়ে পড়েন।
ঘুমের একটা সুবিধের দিকও আছে। অভাব-অভিযোগ শুনতে হয় না। একটু আগেই রানিমা এসে লম্বা ফিরিস্তি শুনিয়ে গেলেন, সরষের তেল বাড়ন্ত, গয়লার টাকা না মেটালে দুধ বন্ধ করে দেবে, মুদির দোকানে তিনশো টাকার ওপর ধার, ঠিকে-লোক কাজ করতে চাইছেনা, দক্ষিণের ঘরে দেওয়ালের চাপড়া খসে পড়েছে, ইত্যাদি।
আজ সবে ঘুমটা এসেছে, হঠাৎ-দু চারজন প্রজা এসে হাজির। ফটিক রায় এসে বলল, “মহারাজ, তামা-তুলসী ছুঁয়ে বলতে পারি, জীবনে কখনও রাজবাড়ির কুটোগাছটিতেও হাত দিইনি। কিন্তু রাজকুমার তার দলবল নিয়ে গিয়ে কী হেনস্থাটাই করল আমাকে পাঁচজনের সামনে। আমার বউয়ের গলার বিচেহারটা নাকি রানিমার বাপের বাড়ির দেওয়া জিনিস, আমার বউমার হাতের বালাজোড়া নাকি মহারাজ মহতাবের আমলে বড় রানিমা পরতেন। তা ছাড়া কাঁসার বাসন, রুপোর গোট এইসবই নাকি রাজবাড়ি থেকে আমিই সরিয়েছি! বলুন তো, গরিবের ওপর এ কী অত্যাচার!…”
নয়ন সামন্ত বুড়োমানুষ। এসে হাতজোড় করে বলল, “মহারাজ, বছরটাক আগে গোবিন্দপুরের গোহাটা থেকে দুধেল গাইটা কিনে এনেছিলুম। সবাই জানে। কোন সুবাদে সেটা রাজবাড়ির গোরু হল সেটা তো বুঝতে পারছি না। রাজকুমারের স্যাঙাতরা গিয়ে বলল, ‘এই তো রাজবাড়ির সেই কামধেনু গোরু। ওরে ব্যাটা, গোরু চুরি করেছিস সেজন্য কিছু বলছি না, কিন্তু রোজ সকালে দু সের করে দুধ দিয়ে আসবি। এর একটা বিহিত না করলে যে গঙ্গাধরপুরের বাস ওঠাতে হবে।’”
গণেশ হালদার হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “খালধারের জমিটা আপনার পিতাঠাকুরের কাছে আমার বাবা ন্যায্য দামে কিনে নিয়েছিলেন মহারাজ, মনে নেই? আমার দলিলও আছে। কিন্তু রাজকুমার সে দলিল স্বীকারই করতে চাইছেন না মোটে। খরচাপাতি করে ধান বুনলুম, তা শুনছি নাকি ফসল সব রাজবাড়িতে তুলে না দিয়ে গেলে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। আপনার রাজত্বে কি শেষে সপরিবার বেগুনপোড়া হয়ে মরব মহারাজ?
সতীশ বিশ্বাস রোগাভোগা ভিতু মানুষ। ভারী কাহিল মুখ করে এসে বলল, ‘“রাজকুমার বহুকাল পরে ফিরে এয়েছেন, তাতে তো আমাদের আনন্দেরই কথা মহারাজ, তা আনন্দ আমাদের হচ্ছেও। খুবই হচ্ছে। কিন্তু উনি বলেছেন, মাসে মাসে দুশো টাকা করে খাজনা না দিলে ওঁর লেঠেলরা আমার বাড়িতে চড়াও হবে। মহারাজ, এত খাজনা তো সরকার বাহাদুরকেও দিতে হয় না। শেষে কি শুকিয়ে মরব?”
কিন্তু শিকদার বলল, “রাজকুমারের ভয়ে আমরা নালিশ জানাতে আসতেও ভয় পাই। তা আজ তিনি সকালবেলায় দলবল নিয়ে কোথায় যেন গেছেন বলে সাহস করে এসেছি। আপনি প্রজাপালক রাজা, আপনি না বাঁচালে আমাদের যে ধন প্রাণ দুটোই যাবে।”
কথাটা ঠিক নয়। রাজা মহেন্দ্রর রাজত্ব বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। প্রজারাও আর তাঁর প্রজা নয়। তবু এদের প্রতি তাঁর একটা দায়িত্ব তো আছে!
ঘটনাটা হল, দশ-বারো বছর আগে তাঁর ছেলে নবেন্দ্র কালীমাস্টারের কানমলা খেয়ে রাগে অভিমানে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। রানিমা কেঁদেকেটে শয্যা নিয়েছিলেন! ছেলেকে খুঁজতে জলের মতো টাকাও খরচ করেছিলেন মহেন্দ্র। কোনও লাভ হয়নি।
মাসখানেক আগে এরকমই এক সকালবেলায় রাজা মহেন্দ্র সিংহাসনে বসে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ পায়ে সুড়সুড়ি লাগায় আঁতকে উঠে দেখেন সামনে লম্বাচওড়া একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে আরও দশ-বারোজন।
ডাকাত পড়েছে ভেবে তিনি হাউমাউ করে উঠলেন, “ওরে বাপু, তোরা বড্ড ভুল জায়গায় এসে পড়েছিস। এ বাড়িতে ডাকাতি করার মতো কিছু আর নেই রে! সেই একান্ন বছর আগে শেষবার ডাকাতি হয়েছিল। এখন ছিচকে চোরও আসে না। তোরা বরং ওই ভল্লনাথ, গোবিন্দ সাউ ওদের বাড়িতে যা।”