তারপর অগ্রহায়ণ গিয়ে এই পৌষ চলছে। কিন্তু গা গরম হওয়ার মতো ঘটনাই ঘটছে না মোটে। গত হপ্তায় নরেন ঘোষের সঙ্গে সাতকড়ি নন্দীর একখানা ঝগড়া হয়েছিল বটে। সাতকড়ি ঝগড়ায় বড্ড ভাল। এমন মোক্ষম কথা কইবে যে, কান জুড়িয়ে যায়। কিন্তু নরেন ঘোষটা কাজের নয়। রেগে গেলে তোতলাতে থাকে, চোখমুখ রাঙা হয়ে যায়। ওরে বাপু, ঝগড়াও তো একটা আর্ট, না কি! মাথাটি ঠান্ডা রেখে পাটে পাটে কথা কইতে হয়, তার মধ্যেই হুল দিতে হয় মিষ্টি করে। গলার ওঠাপড়াও এক এক জায়গায় এক এক রকমের হওয়া চাই। তা দেখা গেল নরেন ঘোষের ঝগড়ায় এখনও অন্নপ্রাশনটাই হয়নি। দু-চার কথার পরই রণে ভঙ্গ দিল। ধুস! ভাল ভাল চর্চা সবই উঠে যাচ্ছে দেশ থেকে!
হরেকেষ্টর জিলিপি আর গোরা ময়রার বোঁদে, এ বলে আমাকে দ্যাখ, ও বলে আমাকে। ঝিকরগাছার হাটে এলে একবার জিলিপি, অন্যবার বোঁদে নবকান্তর বাঁধা। ঘুরে ঘুরে খিদেটা চাগাড় দেওয়ায় নবকান্ত গোরা ময়রার দোকানের দিকে গুটিগুটি এগোচ্ছিল। আজ বোঁদে।
হঠাৎ উদভ্রান্ত চেহারার অল্পবয়সি একটা ছোঁকরা ঝড়ের বেগে এসে তার পথ আটকে বলল, “মশাই, আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন? আমার বড় বিপদ।”
বিপদের কথায় ভারী খুশি হয়ে নবকান্ত বলল, “বাঃ, বাঃ, এ তো খুব ভাল কথা! তা কী বিপদ বেশ খোলসা করে বলো তো!”
ছোঁকরা মাথা নেড়ে বলল, “বলার সময় নেই। এই বাক্সখানা দয়া করে চাঁদরের তলায় ঢুকিয়ে নিন।”
বলেই তার হাতে একটা ভারী কাঠের বাক্স প্রায় জোর করেই গুঁজে দিয়ে বলল, “আমার নাম সনাতন রায়। মাধবগঞ্জে বাড়ি। দয়া করে নামটা মনে রাখবেন।”
বলেই ছোঁকরা ফের ঝড়ের বেগেই উধাও হল।
নবকান্তর একগাল মাছি। ব্যাপারটার মাথামুন্ডু সে কিছুই বুঝতে পারল না। তবে তার কাণ্ডজ্ঞান আছে। সে বুঝল, ব্যাপারটা যাই হোক, তার রহস্যটা এই বাক্সর মধ্যেই ঘাপটি মেরে সেঁদিয়ে রয়েছে। নবকান্ত এদিক-সেদিক চেয়ে বাক্সখানা চাঁদর দিয়ে ঢেকে নিল।
গোরা ময়রার বোঁদের চেহারা যেমন মুক্তোর মতো, স্বাদেও তেমনই। কিন্তু আজ নবকান্ত তেমন স্বাদ পাচ্ছিল না। আনমনে খেয়ে যাচ্ছিল মাত্র। কোলে চাঁদর ঢাকা দেওয়া কাঠের ভারী বাক্সটা। দুশ্চিন্তা সেটা নিয়েই। ছোঁকরা বলছিল যে, তার বড় বিপদ। তা বিপদ যদি এই বাক্সখানার জন্যই হয়, তা হলে সেই বিপদ আবার নবকান্তকেও তাড়া করতে পারে। চোখের সামনে ঘটনা ঘটতে দেখলে নবকান্ত খুশি হয় বটে, কিন্তু তা বলে ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে সে মোটেই ভালবাসে না।
“শ্যামাপদ যে!” বলে একটা বেঁটে মতো, টেকো লোক গদগদ মুখে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
বড্ড অন্যমনস্ক ছিল বলে নবকান্ত কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে চেয়ে রইল।
লোকটা বড় বড় দাঁত বের করে গ্যালগ্যাল করে হেসে বলল, “জেল থেকে পালিয়ে এয়েছ শুনলাম। শুনে ইস্তক বড্ড খুশি হয়েছি। তা পালাবে না-ই বা কেন? জেলখানা কি আর ভাল জায়গা! সব কয়েদিরই উচিত জেল থেকে পালিয়ে আসা। সেইজন্যই তো মুনিঋষিরা বলে গেছেন, কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফ্যাল কররে লোপাট।”
নবকান্ত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলে, “কী বলছেন আমি তো তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“আহা, ভয় পেয়ো না ভায়া। আমি তো আর পাঁচ কান করতে যাচ্ছি না। আমি তেমন লোক নই যে, পুলিশকে খবর দিয়ে তোমাকে ফের ধরিয়ে দেব। পুলিশ তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে বটে, কিন্তু আমার মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বেরোবে না।”
নবকান্ত চটে উঠে বলল, “পুলিশ! পুলিশ আমাকে খুঁজবে কেন মশাই?”
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আহা, ওইটেই তো পুলিশের দোষ। জেল থেকে পালালে এমন কী দোষ হয় বাপু, তাও তো বুঝি না। কী সুখের জায়গা সেটা শুনি! বিছানায় ছারপোকা, মশার কামড়, ইঁদুর, আরশোলার উৎপাত, তার ওপর খাওয়ার যা ছিরি! লপসি আর ঘ্যাঁট। ছ্যাঃ, ছ্যাঃ, জেলখানা কি একটা থাকার মতো জায়গা হল বাপু? না হয় মুকুন্দপুরের শীতল দাসকে তুমি খুনই করেছ, কিন্তু তাতে কী? শীতল দাসও তো আর সাধুসজ্জন ছিল না! তার পাপের ফিরিস্তখানাও তো কম লম্বা নয়। খুনটা করে দেশের একরকম উপকারই তো করেছ হে!”
নবকান্ত দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “শীতল দাসকে খুন করেছি কিনা জানি না মশাই, তবে এখন আমার একটা লোককে খুন করতে খুব ইচ্ছে করছে। আর সেই লোকটা আপনি।”
যেন ঠাট্টার কথা শুনছে এমনভাবে হেঃ হেঃ করে হেসে লোকটা বলল, “ওইটেই তো তোমার দোষ শ্যামাপদ। এমনিতে তো তুমি লোক খারাপ নও। আমরা তো বলি, শ্যামাপদর মাথাটি ঠান্ডা থাকলে সে একেবারে গঙ্গাজল, আর মাথা গরম হলে সে মুচির কুকুর। রাগটা সামাল দিতে পারো না বলেই না এই অবধি সাতটা না আটটা খুন করে ফেলেছ। দু-একটা বেশি কম হতে পারে, সেটা ধরছি না। তা যাকগে ভাই, সেসব কথা বাদ দাও। কিন্তু জেলখানার মতো বিচ্ছিরি জায়গা থেকে যে বেরিয়ে এসেছ তা দেখে বড় আনন্দ হচ্ছে। তা তোমার কাঁকালে চাঁদরে ঢাকা ওটি কী বলো তো! ক্যাশবাক্স মনে হচ্ছে।”
নবকান্ত হুংকার দিয়ে বলল, “কে বলেছে ক্যাশবাক্স?”
“তা বাপু, ক্যাশবাক্স কি আর খারাপ জিনিস? টক করে অমন রেগে যাও কেন বলো তো! হাটে এসে যদি কারও ক্যাশবাক্স হাতিয়েই নিয়ে থাক, তা হলে অন্যায়টাই বা কী হয়েছে বলো! ওসব একটু-আধটু না করলে তোমার চলবেই বা কীসে? জেলখানা থেকে পালিয়ে এসেছ, এখন পয়সাকড়ি না হলে চলে! আমি তো এর মধ্যে খারাপ কিছু দেখছি না। তা কেমন পেলে ক্যাশবাক্সে, দু-চার হাজার টাকা হবে না?”