“আজ্ঞে না মহারাজ, পৃথিবীতে আর-একটা যখ বাড়াতে চাই না। আপনার ষষ্ঠ উত্তরপুরুষের ওপর অন্যায় হামলা করায় এশাস্তি ওর পাওনাই ছিল।”
“ও, ভাল কথা চন্দ্রকুমার, আমার সেই উত্তরপুরুষটি কোথায়? সে নিরাপদে আছে তো!”
“ব্যস্ত হবেন না মহারাজ। ছোঁকরা একটু বিপদের মধ্যেই আছে।
তবে জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতা, বিপদআপদ ঘটা ভাল। তাতে মানুষ শক্তপোক্ত হয়, আত্মরক্ষা করতে শেখে, বুদ্ধি আর কৌশল বৃদ্ধি পায়, বাস্তববোধ জেগে ওঠে।”
চোখের রক্ত মুছে গগন ভাল করে চেয়ে হাঁ করে রইল। তার সামনে ঘরের মধ্যে দুটো বিশাল মূর্তি দাঁড়িয়ে। দুজনেরই পরনে ঝলমলে রাজাগজার পোশাক। গগন হুঙ্কার দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু গলা দিয়ে চিচি শব্দ বেরোল, “ওরে চোর, তোরা এ-ঘরে ঢুকলি কী করে?”
তার কথায় কেউ ভুক্ষেপ করল না। গগন দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। তারপর সর্বশক্তি দিয়ে খাঁড়াখানা দেওয়াল থেকে টেনে হঠাৎ আচমকা ঘ্যাচাং করে এককোপে কেটে ফেলল একজনকে।
“আহা হা, চন্দ্রকুমার! তোমাকে যে একেবারে দু-আধখানা করে কেটে ফেলল! সর্বনাশ!”
চন্দ্রকুমার একটু হেসে বলে, “আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, ঘনীভূত অবস্থায় ছিলাম কিনা! তাই কেটে ফেলতে পেরেছে। তবে জুড়ে নিতে দেরি হবে না।”
চন্দ্রকুমারের শরীরের নীচের অংশটি আলাদা হয়ে সারা ঘরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। চন্দ্রকুমার বললেন, “আমার ওই অংশটি কিছু দুষ্ট প্রকৃতির…” বলতে বলতে তিনি গিয়ে ওই অংশটি আবার প্যান্ট পরার মতো সহজেই জুড়ে নিলেন শরীরে।
গগন সাঁপুই খাঁড়াসমেত ফের মেঝের ওপর পড়ে গেছে। বিড়বিড় করে সে বহুঁকাল আগে শোনা কণার্জুন’ নাটকের একখানা সংলাপ বলে যাচ্ছে, “চলে গেলি একবিঘাতিনী, মরণের নামমাত্র করিয়া প্রচার, কিরিটীর কিরিট ভূঁইয়া?”
“ওহে গগন!”
গগন দুখানা হাত জোড় করে বলে, “যে আজ্ঞে।”
“কেমন বুঝছ?”
“আজ্ঞে, আপনাদের সঙ্গে এঁটে উঠব না।”
“মোহরের থলিটা যে এবার বের করতে হবে ভায়া।”
গগন খুব অবাক গলায় বলে, “মোহর! হুজুর, মোহরটা আবার কোথায় দেখলেন? কু-লোকে কুকথা রটায়।”
“তোমার চেয়ে কু-লোক আর কে আছে বাপু? একটু আগে তুমি মহারাজের ষষ্ঠ উত্তরপুরুষকে খুন করতে দুটো খুনিকে পাঠিয়েছ। তুমি অন্যায়ভাবে পরস্পাপহরণ করেছ।”
“আজ্ঞে না হুজুর, আমি পরের অপকার করিনি। আর সেই চোর যে মহারাজের কেউ হন, তাও জানতুম না কিনা!”
“কিন্তু মোহর!”
গগন কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “আজ্ঞে, ভগবান দিয়েছেন। তাই…”
“এই যে মহারাজকে দেখছ, ইনি মোহরের খপ্পরে পড়ে দেড়শো বছর পাতাল-ঘরে মাটিচাপা ছিলেন।”
গগন ডুকরে উঠল, “ওরে বাবা, আমি মোটে বন্ধ জায়গা সইতে পারি না। ছেলেবেলায় একবার পাতকুয়োর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, সেই থেকে বেজায় ভয়।”
“তা হলে উঠে পড়ো গগন! মোহর বের করে ফ্যালো।”
গগন হাতজোড় করে বলে, “বড্ড লোকসান হয়ে যাবে যে!”
“মোহর তো আলমারি খুলে আমিই বের করতে পারি। কিন্তু তাতে তো তোমার প্রায়শ্চিত্ত হবে না গগন। ওঠো। আর দেরি নয়। তারা আসছে।”
“হুজুর, বড্ড গরিব হয়ে যাব যে। কোটি-কোটি টাকা থেকে একেবারে পপাতধরণীতলে! দু-চারখানা যদি রাখতে দেন।”
“দু’শো এগারোখানা মোহর গুনে দিতে হবে। ওঠো।”
“আজ্ঞে, মাজায় বড় ব্যথা। দাঁড়াতে পারছি না।”
“তা হলে হামাগুড়ি দাও। তুমি দুর্বিনীত, হামাগুড়ি দিলে কিছু বিনয় প্রকাশ পাবে।
.
গগন মোহরের থলি নিয়ে যখন হামাগুড়ি দিয়ে বেরোল, তখন উঠোনে বহু লোক জমায়েত হয়েছে। অনেক মশাল জ্বলছে। ভিড়ের মাঝখানে রোগা ছেলেটা দাঁড়িয়ে।
গগন সিঁড়িতে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেল। মোহরের থলিটা উঁচুতে তুলে ধরে বলল, “বড্ড গরিব হয়ে গেলাম, আত্তে।”
লাঠি হাতে একটা লোক দু’পা এগিয়ে এসে বলল, “গগনবাবু, দুটো বা হাতওলা লোক এই এতক্ষণে খুঁজে পেলাম। কথাটা সারাদিন মাথায় চক্কর দিচ্ছিল। আপনারই মশাই, দুটোই রাঁ হাত। ডান হাতেও তো আপনি অশুদ্ধি কাজই করেন। কাজেই ওটাও বাঁ হাতই।” বলে লক্ষ্মণ পাইক চারদিকে একবার চাইল, “আর ন দিয়ে নামের আদ্যক্ষর…”
নটবর ঘোষ টপ করে মাথাটা নামিয়ে ফেলায় লক্ষ্মণ বলে উঠল, “আপনিও খারাপ লোক নটবরবাবু। তবে এ-আদ্যক্ষর আপনার নামে নয়। নামটা আমারই। আমার পিতৃদত্ত নাম নরহরি। নামটা ভুলে গিয়েছিলাম।”
গাঁ-সুদ্ধু লোক হেসে উঠল।