চোর ধরার পর্ব একরকম শেষ হয়েছে। চোরটাকে পাইকরা আবার ধরাধরি করে লাকড়ির ঘরে তুলে নিয়ে গেল। একে-একে লোকেরা ফিরে যাচ্ছে। পটল গাঙ্গুলি আর বিজয় মল্লিকও উঠে পড়লেন।
নটবর ঘোষ যাওয়ার আগে বললেন, “তোমার বাড়িতে কী করে যে চোরটা ঢুকল সেটাই আমার মাথায় ঢুকছে না। এ তো বাড়ি নয়, দুর্গ।”
কাঁচুমাচু মুখে গগন বলল, “নিত্যানন্দ ঘোষালের জমির ওই বেলগাছটাই যত নষ্টের গোড়া। দেখুন না, ওই তো দেখা যাচ্ছে। আগে এত বাড়বাড়ন্ত ছিল না গাছটার, এবার হয়েছে। গাছের ডাল বেয়ে এগিয়ে ওই খড়ের গাদায় ঝাঁপ খেয়ে পড়েছিল বোধহয়। আপনারা সবাই মিলে বলে কয়ে বুঝিয়ে গাছটা কাটিয়ে ফেলতে ঘোষালকে রাজি করান। আমি অনেক বলেছি, ঘোষাল কথাটা কানেই তোলে না।”
“বেলগাছ কাটতে নেই হে বাপু। তুমি বরং আরও একটু সজাগ থেকো। এক চোর যখন ঢুকেছে, আরও চোর এল বলে।”
লোকজন সব বিদেয় হয়ে যাওয়ার পর গগন সাঁপুই পাইকদের ডেকে বলল, “ওরে, আর দেরি নয়, ছোঁড়ার জ্ঞান ফেরার আগেই ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে রথতলার মাঠে রেখে আয়। থানা-পুলিশের হাঙ্গামা কে করতে যাবে বাবা! জ্ঞান ফিরলে বাছাধন আপনিই চম্পট দেবেখন। যা-যা, তাড়াতাড়ি কর। একটু চুপিচুপি কাজ সারিস বাবা, কেউ টের পেলে আবার পাঁচটা কথা উঠবে।”
লক্ষ্মণ পাইক একটু হতাশ হয়ে বলল, “ছেড়ে দেবেন! এই চোরটার পেট থেকে যে অনেক কথা টেনে বের করা যেত। চোরদের পেছনে দল থাকে। পুরো দলটাকেই ধরা যেত তা হলে?”
গগন ঘনঘন মাথা নেড়ে বলে, “ওরে বাবা, চন্দ্র-সূর্য যতদিন আছে পৃথিবীতে চোর-ছ্যাঁচড়ও ততদিন থাকবে। কত আর ধরবি? আমি শান্তিপ্রিয় লোক, চোর ধরে আরও গোলমালে পড়তে চাই না। আপদ বিদেয় হলেই বাঁচি। চল আমিও সঙ্গে যাচ্ছি।”
লক্ষ্মণ পাইক বলবান লোক। একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “লোকলস্কর লাগবে না, বড়বাবু। আপনাকেও সঙ্গে যেতে হবে না। চোরটা একেবারেই হালকা-পলকা। আমি একাই কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে রেখে আসছি।”
“তাই যা বাবা, পাঁচটা টাকা বকশিশ পাবি।”
লক্ষ্মণ পাইক লাকড়ির ঘরে ঢুকে রোগা ছেলেটার সংজ্ঞাহীন দেহটি বাস্তবিকই ভাঁজ করা চাঁদরের মতো ডান কাঁধে ফেলে রওনা হল। রথতলার মাঠ বেশি দূরে নয়। রায়বাবুদের আমবাগান পেরোলেই বাঁশঝাড়। তারপরেই রথতলা। জোরকদমে হাঁটলে পাঁচ মিনিটের রাস্তাও নয়।
নিশুত রাত। চারদিক নিঃঝুম। লক্ষ্মণের বাঁ হাতে টর্চ। মাঝে-মাঝে আলো ফেলে সে অন্ধকার বাঁশঝাড়টা পেরিয়ে রথতলায় পৌঁছে গেল। চারধারে একবার তাকিয়ে দেখে নিয়ে ছোঁড়াটাকে হড়াম করে ফেলে দিল ঘাসের ওপর।
ফিরে যাওয়ার আগে লক্ষ্মণ অন্ধকারে একটু দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথাটা যদিও নীরেট এবং ভাবনা-চিন্তা তার মাথায় বিশেষ খেলে না, তবু এখন সে এই ছোঁকরার কথাটা একটু ভাবছে। এই মাঠে পড়ে থাকলে একে সাপে কাটতে পারে, শেয়ালে কামড়াতে পারে, ঠাণ্ডা লেগে অসুখ করতে পারে। লক্ষ্মণ তার মনিবের হুকুম তামিল করেছে বটে, কিন্তু তার মনটা কেন যেন খুঁতখুঁত করছে।
একটু আনমনা ছিল লক্ষ্মণ, হঠাৎ ঘোর অন্ধকার থেকে একটা লম্বা হাত এগিয়ে এসে তার কাঁধে আলতোভাবে পড়ল।
“কে রে শয়তান?” বলে লক্ষ্মণ বিদ্বেগে ঘুরে তার বিশাল হতে একখানা মোক্ষম ঘুসি চালাল। ঘুসিটা কোথাও লাগল না। উলটে বরং ঘুসির তাল সামলাতে না পেরে লক্ষ্মণ নিজেই বেসামাল হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। তখন দুখানা লোহার মতো হাত তাকে ধরে তুলল। কে যেন বলল, “ঘাবড়ে যেয়ো না, মাথা ঠাণ্ডা করো। কথা আছে।”
কেমন যেন ফ্যাসফেসে গলা। সাপের শিসের মতো। শুনলে ভয়-ভয় করে। লক্ষ্মণ একটু ঘাবড়ে গিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে?”
“সে-কথা পরে হবে।” লক্ষ্মণ টের পেয়েছে, লোকটার গায়ে বেজায় জোর। তার চেয়েও বেশি। সে সতর্ক গলায় বলল, “কথা কিসের? আমাকে এখনই ফিরতে হবে। দাঁড়ান, টর্চটা পড়ে গেছে, তুলি।”
“টর্চটা আমার পায়ের নীচে আছে। যাওয়ার সময় পাবে। কিন্তু যাওয়ার আগে কয়েকটা কথার জবাব দিয়ে যেতে হবে।”
“আপনি বোধহয় এই চোরটার শাগরেদ!”
“হতেও পারে। এখন বলো তো, ওকে এখানে ফেলে যাওয়ার মানেটা কী?”
“গগনবাবু বললেন তাই ফেলে যাচ্ছি। তিনি পুলিশের হাঙ্গামা চান। তাঁর দয়ার শরীর, ছোঁকরাকে পালানোরও পথ করে দিলেন। জ্ঞান ফিরে এলে চলে যাবে।”
লোকটা হাত-দুই তফাতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। তবে বেশ লম্বা চেহারা, এটা বোঝা যাচ্ছে। লোকটা ফ্যাসফেসে রক্ত-জল করা সেই গলায় বলল, “ও যে চোর তা ঠিক জানো?”
লক্ষ্মণ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “নিয্যস চোর। চোরাই জিনিস অবধি পাওয়া গেছে।”
“কী জিনিস?”
“তা আমি জানি না। গগনবাবু জানে।”
“রাত-পাহারায় কি তুমি ছিলে?”
“আমি আর শম্ভু।”
“চোর কীভাবে ঢুকল জানো?”
“বেলগাছের ডাল বেয়ে এসে খড়ের গাদায় লাফিয়ে নামে। কুকুরগুলো তখনই চেঁচাতে শুরু করে। আমরাও লাঠি আর বল্লম নিয়ে দৌড়ে যাই।”
“গিয়ে কী দেখলে?”
“কিছু দেখিনি। তবে খড় ছিটিয়ে পড়ে ছিল। কুকুরগুলো লাকড়ির ঘরের দিকে দৌড়ে গেল।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? বাড়ির সবাই উঠে পড়ল। চেঁচামেচি হতে লাগল। চোরও ধরা পড়ে গেল।”
“তা হলে চোরটা চুরি করল কখন?”