নাঃ, উঁচু দেওয়াল থাকলে কী হয়, এ-দেওয়াল টপকানো কঠিন কাজ নয়। দুটো কুকুর আছে বটে, কিন্তু জানোয়ার আর কতটাই বা কী করতে পারে! পাইক আর কাজের লোকজন আছে বটে, কিন্তু লোকবলটা মোটেই যথেষ্ট নয়। ডাকাত যদি পড়ে তবে মহড়া নেওয়ার ক্ষমতা এদের নেই। দরজা-জানলা খুবই মজবুত কিন্তু অভেদ্য নয়। বড়জোর দুর্ভেদ্য বলা যায়। শালবল্লা দিয়ে গুঁতো মারলেই মড়মড় করে ভেঙে পড়বে। বাড়িতে দু-দুটো বন্দুক আছে, কিন্তু ডাকাতরা যদি সাত-আটটা বন্দুক নিয়ে আসে, তা হলে? নাঃ, বাড়ির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় মোটেই খুশি হল না গগন। দিনের আলো ফুরোবার আগেই আরও পাকা ব্যবস্থা করা দরকার। বাড়িতে যত লাঠি, দা, কুড়ল, কাটারি, টাঙি, ট্যাটা, বল্লম, সড়কি, ছোরাছুরি ছিল, গগন সব বের করে জড়ো করল দাওয়ায়। বাড়ির লোককে ডেকে বলল, “ডাকাত পড়ার কথা আছে। সবাই খুব সাবধান। প্রত্যেকেই অস্ত্র রাখবে হাতে।”
তিন ছেলের দু’জন বন্দুক হাতে সন্ধে থেকেই মোতায়েন রইল দাওয়ায়। পাইক আর কাজের লোকজনদেরও সজাগ করে দেওয়া হল। একজন কাজের লোক তীর-ধনুক নিয়ে ঘরের চালে উঠে বসে রইল।
গগন ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজায় খিল এঁটে মোহরের থলিটা বের করে গুণে দেখল। নাঃ, দুশো এগারোখানাই আছে। তারপর দরজায় তিন ডবল তালা লাগিয়ে এক হাতে রাম-দা অন্য হাতে বল্লম নিয়ে উঠোনে পায়চারি করতে লাগল। তবু ব্যবস্থাটা তার মোটেই নিরাপদ মনে হচ্ছে না। পাশেই নারায়ণপুর গাঁয়ে কয়েক ঘর লেঠেল চাষি বাস করে। কাল সকালেই তাদের কয়েকজনকে আনিয়ে নিতে হবে।
ঘরের চাল থেকে হঠাৎ ধনুকধারী কাজের লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, “ওই আসছে!”
গগন একটা লাফ দিয়ে উঠল, “কে! কে আসছে রে? কার আবার মরার সাধ হল? কোন নরাধম এগিয়ে আসছিস মৃত্যুমুখে? আজ যদি তোর মুণ্ডু নিয়ে গেণ্ডুয়া না খেলি তো আমার নাম গগনই নয়..”
বলতে বলতে গগন ছুটে সদর দরজার বাইরে গিয়ে রাম-দা ঘোরাতে-ঘোরাতে চেঁচিয়ে উঠল, “আয়! আয়! আজই কীচক বধ হয়ে যাক।”
যে-লোকটা সদর দরজার কাছ বরাবর চলে এসেছিল, সে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “রক্ষে করুন কাবাবু! আমি লক্ষ্মণ।”
গগন উদ্যত রাম-দা নামিয়ে বলল, “লক্ষ্মণ, তুই কোথা থেকে?”
“আজ্ঞে, একটু খবর আছে। ভাল খবর। চোরটা ধরা পড়েছে।”
গগন হকচকিয়ে গিয়ে বলে, “ধরা পড়েছে মানে! তার তো ধরা পড়ার কথা নয়।”
লক্ষ্মণ নিজের ঘাড়ে হত বোলাতে-বোলাতে বলে, “ছেড়ে দেওয়াটাই ভুল হয়েছিল কাবাবু। চোরের স্বভাব যাবে কোথায়! কু-মতলব নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল, গাঁয়ের লোকেরা ধরে চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ে গেছে। লোক জড়ো হয়েছে মেলা।”
গগন বিরক্ত হয়ে বলে, “আচ্ছা আহাম্মক তো! ছেড়ে দিয়েছি; চলে যা। ফের ঘোরাফেরা করতে এল কেন?”
“আজ্ঞে, মোহর-টোহর নিয়ে কীসব কথাও হচ্ছে যেন। আমার ঘাড়ে বড় চোট হয়েছে বলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। ঘাড়ে মালিশ করতে হবে।”
মোহর নিয়ে কথা! গগনের বুকটা একটু দুলে উঠল। সে ভেবে নিয়েছিল, ছোঁকরা কোথা থেকে চুরি করে মোহর নিয়ে পালাচ্ছিল। বেকায়দায় তার বাড়িতে ঢুকে ধরা পড়ে যায়। যে পরিমাণে ভয় খেয়ে গিয়েছিল তাতে তার এ-তল্লাটে থাকার কথাই নয়। যদিও চোরের কথায় কেউ বিশ্বাস করবে না, তবু কথাটা পাঁচকান হওয়া ভাল নয়। ভগবান যখন ছল্পর ছুঁড়ে দিলেনই এখন ভালয়-ভালয় শেষরক্ষা হলে হয়।
ভগবানকে ডাকতে-না-ডাকতেই ঘরের চাল থেকে কাজের লোকটা আবার চেঁচাল, “ওই আসছে!”
“কে! কে! কোন ডাকাত! কোন গুণ্ডা! কোন বদমাশ..” সদর দরজার বাইরে দুই বিশাল চেহারার লোক এসে দাঁড়াল।
তাদের একজন অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলল, “কাজটা কি ভাল করলেন গগনবাবু?”
গগন উদ্যত বল্লমখানা নামিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলে, “পীতাম্বর নাকি রে?”
পীতাম্বর অত্যন্ত করুণ গলায় বলে, “সবাই যে ছ্যাঃ-ছ্যাঃ করছে গগনবাবু! আমাদের মান-ইজ্জত যে আর রাখলেন না আপনি! এমনকী কালী কাপালিক অবধি নাক সিঁটকে বলল, “মাত্র বাহান্ন টাকায় আমার গায়ে হাত তুললে তোমরা! যার ঘরে দুশো এগারোখানা মোহর,সে মাত্র বাহান্ন টাকায় তোমাদের মতো রুস্তমকে কিনে নিল! এখন আপনিই বলুন গগনবাবু, আপনার জন্য কীরকম অপমানিত হতে হল আমাদের!”
চোখ কপালে তুলে গগন বলে, “মোহর! অ্যাঁ! মোহর! তাও আবার দুশো এগারোখানা! কালীর এই গল্প বিশ্বাস করে এলি তোরা? কালী দশটা কথা বললে তার মধ্যে এগারোটা মিথ্যে কথা থাকে! মোহর আমি জন্মেও দেখিনি রে ভাই, কেমন দেখতে হয় তাই জানি না। গোল না চৌকো, তেকোনা না চারকোনা কে জানে বাবা!”
পীতাম্বর গম্ভীরতর গলায় বলে, “সেটা মিথ্যে না সত্যি তা জানি না। তবে বাহান্ন টাকাটা তো আর মিথ্যে নয়। বড্ড শস্তার দরে ফেলে দিলেন আমাদের। জাতও গেল, পেটও ভরল না। সবাই জানল, কালু আর পীতাম্বর আজকাল ছিচকে কাজ করে বেড়ায়। কেউ পুঁছবে আর আমাদের?”
গগন গদগদ হয়ে বলল, “আয় রে ভাই, ভেতরে আয়। লোকসান যা হয়েছে পুষিয়ে দিচ্ছি। মানীর মান দিতে আমি জানি রে ভাই। আয়, আয়, পেছনের উঠোনে নিরিবিলিতে গিয়ে একটু কথা কই।”
পেছনের উঠোনে দুটো মোড়ায় দুজনকে সমাদর করে বসিয়ে গগন একটু হেঁ-হেঁ করে নিয়ে বলে, “কত চাই তোদের বল তো!”