পীতাম্বর একটা হুঙ্কার দিয়ে বলে, “বেশি বুকনি দিলে মুখ তুবড়ে দেব বলছি!”
কালু বলে ওঠে, “উঁহু উঁহু, আর নয়। টাকা উশুল হয়ে এখন কিন্তু বেজায় লোকন যাচ্ছে আমাদের।”
পীতাম্বর সঙ্গে-সঙ্গে নরম হয়ে বলে, “তা বটে, ওরে কালী, বাহান্ন টাকার কথা তুলে আর আঁতে ঘা দিস না। ওই হাড়কেপ্লনটার সঙ্গে দরাদরিতে যাওয়াই ভুল হয়েছে। এখন সুদে-আসলে লোকসানটা তুলতে হবে।”
কালী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে আর তোমরা পারবে না। সকলের চোখের সামনে দুশো এগারোখানা মোহর যে-মানুষ হাতিয়ে নিতে পারে, তার সঙ্গে এঁটে ওঠা তোমাদের মতো ভালমানুষদের কর্ম নয়। আর এ-গাঁয়ের লোকগুলোও সব চোখে ঠুলি-আঁটা ঘানির বলদ। খুন করে লাশটা কোথায় গুম করল সেটা অবধি খুঁজে দেখল না। ছোঁকরার আত্মাটা এই সন্ধেবেলাতেও এসে কত কাঁদাকাটা করে গেছে। একটু আগেই তো তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তোমরা এসে হুজ্জত শুরু করায় ভয় খেয়ে তফাত হয়েছে। আমার আধসের দুধ আর কয়েকখানা ইট বড় করে দেখলে পীতাম্বরদাদা, কালুভাই! ওদিকে যে পুকুরচুরি হয়ে গেল, সে-খবর রাখলে না! লোকটা কত বড় পিচাশ একবার ভেবে দ্যাখো, দুশো এগারোখানা মোহর টাকে গুঁজেও যে মাত্র বাহান্ন টাকায় তোমাদের কেনা গোলাম করে রাখতে চাইছে! আর শুধু কী তাই, ওই দ্যাখো, তোমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য লক্ষ্মণ পাইককে পাঠিয়েছে! ওই যে, বাবলাতলায় দাঁড়িয়ে!”
পীতাম্বর আর কালু চিতাবাঘের মতো ঘুরে দাঁড়াতেই বাবলাতলা থেকে লক্ষ্মণ বেরিয়ে এসে পীতাম্বরের দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠল, “অনেক আগেই আন্দাজ করেছিলাম যে, তুমিই সেই লোক! আর লুকোছাপা করে লাভ নেই বাপু! আমি আবছা আলোতেও ঠিক বুঝতে পেরেছি, তোমার দুটো হাতই বাঁ হাত।”
পীতাম্বর একথায় এমন অবাক হয়ে গেল যে, তার মুখে কথা জোগাল না। খানিকক্ষণ লাগল সামলে উঠতে। তারপর বাঘা গলায় বলল, “কী বললি রে হনুমান?”
লক্ষ্মণ বিন্দুমাত্র ভয় না খেয়ে একটু হেসেই বলল, “সারাদিনের পরিশ্রম আজ সার্থক। রাম বিশ্বাসের কথা কি মিথ্যে হওয়ার যো আছে! দুটো বাঁ-হাতওলা লোক থাকতেই হবে!”
পীতাম্বর নিজের হাত দুখানা চোখের সামনে তুলে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলে, “কোথায় রে দুটো বাঁ হাত! আর থাকলে আমি তা এতদিনে টের পেতুম না! আচ্ছা বেল্লিক তো তুই দেখছি!
আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে এসে এখন আবোলতাবোল বলে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করছিস হতভাগা! দেখাচ্ছি মজা।”
দুহাতে বজ্রমুষ্টি পাকিয়ে পীতাম্বর লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করতেই কালু তার হাত চেপে ধরে বলল, “কত লোকসান যাচ্ছে খেয়াল করেছিস? এখন কিল-চড় খরচা করলে তার দামটা দেবে কে? বাহান্ন টাকার একটি পয়সাও কি বেশি আদায় হবে?”
“তা বটে!” বলে পীতাম্বর বন্ধ করা মুঠি খুলে, দমটা ছেড়ে ক্লান্ত গলায় বলে, “গাড়লটা বলছে কিনা আমার দুটোই বাঁ হাত! সেই জন্ম থেকে বাঁ-ডান দুই হাত নিয়ে বাস করে এলুম, হঠাৎ রাতারাতি জলজ্যান্ত হাতটা বদলে যাবে! এই যে ভাল করে দেখে নে আহাম্মক, ডান বা জ্ঞান যদি থেকে থাকে, তবে ভাল করে পরখ করে নে। তোর কপালের খুব জোর, এই দুটো হাতের ঘুসো তোকে খেতে হয়নি। নইলে…”
পীতাম্বরের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ লাঠি হাতে একটা লম্বা সিঁড়িঙ্গে মূর্তি বাবলাবনের শুড়িপথটা দিয়ে ধেয়ে এল, “মারবে মানে? ইয়ার্কি পেয়েছ? এ কি মগের মুলুক? আমার রাজসাক্ষী মারলে অত বড় বাটপাড়ি আর খুনের কিনারা করবে কে?”
বলতে বলতেই গৌরগোবিন্দ হাতের মজবুত লাঠিটা তুলে পটাং-পটাং করে পেটাতে লাগলেন। পীতাম্বর আর কালু বহুঁকাল কারও হাতে মার-টার খায়নি। সবাই তাদের সমঝে চলে, কেউ গায়ে হাত তুলবার সাহসই পায় না। ফলে তারা এত অবাক হয়ে গেল যে, নিজেদের বাঁচানোর কোনও চেষ্টাই করতে পারল না। উপরন্তু মার না খেয়ে-খেয়ে এমন অনভ্যাস হয়ে গেছে যে, দুজনেই প্রথম চোটের লাঠির বাড়িটা খেয়েই ‘বাবা রে’ বলে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে কুমড়ো গড়াগড়ি দিতে লাগল।
“বলি ও কালী, তুই ভাল আছিস তো বাপ! চোট-টোট লাগেনি তো! কোথায় পালালি বাবা? ভয় নেই রে, গুণ্ডা দুটোকে দিয়েছি ঠাণ্ডা করে। ওই দ্যাখ, কেমন চিতপটাং হয়ে পড়ে আছে।”
ঠিক এই সময়ে কে যেন পেছন থেকে বলে উঠল, “এই বয়সেও বেশ ভাল হাত আপনার। লাঠিখানা বেশ গুছিয়ে ধরেছিলেন বটে। ঠিক এরকমটা দেখা যায় না।”
গৌরগোবিন্দ তেড়ে উঠলেন, “বয়সটা আবার কোথায় দেখলে হে। কিসের বয়স? বয়সের কথা ওঠেই বা কেন? আর লাঠি ধরারই বা কী নতুন কায়দা দেখলে? চিরকাল লাঠিহাতে ঘুরে বেড়ালুম!”
“আজ্ঞে, তা বটে। কিন্তু যার দুটো হাতই বাঁ হাত, তার পক্ষে ওভাবে জুতসই করে বাগিয়ে ধরে লাঠি চালানো তো বড় সোজা কথা নয় কি না!”
গৌরগোবিন্দ একটু ঝুঁকে লোকটাকে ঠাহর করে নিয়ে বললেন, “অ, তুমি গগন সাঁপুইয়ের সেই পাইক লক্ষ্মণ বুঝি! সকাল থেকে বাঁ হাতের ফেরে পড়ে আছ দেখছি! তা কালীর ঠেক-এ তোমার আবার কী দরকার? অ্যাঁ! সাক্ষী গুম করতে এসেছ? দেখাচ্ছি মজা, দাঁড়াও…”
হঠাৎ করে লাঠির একখানা ঘা ঘাড়ে পড়তেই লক্ষ্মণ আর কালবিলম্ব করে চোঁচা দৌড় লাগাল।