বলে হাতের লাঠিখানা বাগিয়ে ধরে গৌরগোবিন্দ চণ্ডীমণ্ডপ থেকে নেমে তাঁর জুতো খুঁজতে লাগলেন ব্যস্ত হয়ে।
বিজয় মল্লিক হাঁ-হাঁ করে ওঠেন, “করো কী ঠাকুরদা, তারা দুটি যে সাক্ষাৎ যমের স্যাঙাত! মহাকালীর পুজোয় ওই কালুটা যে এক হাতে এক কোপে মোষের গলা নামিয়ে দেয়, দ্যাখোনি? আর পীতাম্বরটা তো চরকির মতো তলোয়ার ঘোরায়।”
গৌরগোবিন্দ খিঁচিয়ে উঠে বলেন, “তা বলে রাজসাক্ষী হাতছাড়া করব? এতদিন বাদে একটা ঘটনা ঘটল গাঁয়ে, সেটার মাথায় ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেব? আর কালু-পীতাম্বর যখন আসরে নেমে পড়েছে তখন বলতেই হবে বাপু, কালী কাপালিকের কথায় একটু যেন সত্যি কথাও আছে। না বাপু, আমাকে দেখতেই হচ্ছে ব্যাপারটা।”
রাম বিশ্বাস চণ্ডীমণ্ডপের এককোণে বসে বাতাসে ট্যাড়া কাটছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, “কালীর এখনই মৃত্যুযোগ নেই, সকালেই কপালটা দেখেছি ভাল করে।”
গৌরগোবিন্দ আর কোনও দৃকপাত না করে ছুটতে লাগলেন।
ইটখোলায় কালী কাপালিকের থানে দৃশ্যটা একটু অন্যরকম। যেমনটা ভাবা গিয়েছিল তেমনটি নয়।
সন্ধেবেলায় কালী একটু সিদ্ধি-টিদ্ধি খায়। বান মারে, ব্যোম-ব্যোম করে আর তার তিন-চারজন চেলা ধুনির আগুনে রান্না চাপায়।
বেশ শান্ত নিরিবিলি জায়গা। হাওয়া দিচ্ছে। চারদিক বেশ খোলামেলা। কালী তার শিষ্যদের বলছিল, “গগন ব্যাটার বুকের পাটা দেখনি তো! কী এমন চাইলুম রে বাবা! চোরাই মোহরগুলোর কথা তো পাপমুখে উচ্চারণও করিনি। এমনকী খুনটার কথাও চেপে গেছি। তা তার…একটা দাম দিবি না? নিজের জন্য কী চেয়েছি? পাঁচটা ভক্ত আসবে, ভদ্রলোকেরা আসবে, তীর্থ হিসাবে শিমুলগড়েরই নাম হবে। কয়েক হাজার ইট আর কয়েক বস্তা সিমেন্ট হলেই হয়ে যেত। তার বদলে কয়েক বস্তা পুণ্যি! আর আধসের করে দুধ–সেটাও তার বড্ড বেশি মনে হল নাকি রে? ভক্তকে দুধ খাওয়ালে ভগবান খুশি হন, সেইটেই বুঝল না ব্যাটা পাপী।”
অন্ধকারে বাবলাবনের ভেতরের শুড়িপথটা দিয়ে দুটো ছায়ামূর্তি আসছিল। তারা আড়াল থেকে কথাটা শুনতে পেল। শুনে পীতাম্বর একখানা হাঁক পাড়ল, “এই যে, খাওয়াচ্ছি তোমাকে দুধ! আর ইটের বন্দোবস্তও হচ্ছে।”
কালী প্রথমটায় কিছু বুঝে উঠবার আগেই পেল্লায় চেহারার দুটো লোক এসে তার ওপর পড়ল। গালে বিশাল এক থাবড়া খেয়ে কালী চেঁচিয়ে উঠল, “মেরে ফেললে রে!”
চেলারা ফটাফট আড়ালে সরে গেল। চেঁচামেচি শুনে আশপাশ থেকে ছুটে এল কিছু লোক। তবে তারা বেশি এগিয়ে এল না। কালু আর পীতাম্বরকে সবাই চেনে।
কালু পর-পর আরও দুখানা চড় কষাতেই পীতাম্বর বলে উঠল, “আহ, খামোখা চড়গুলো খরচা করছিস কেন? বত্রিশটা টাকার বেশি তো আর কঞ্জুষটার কাছ থেকে আদায় হবে না। আটখানা কর।” এই বলে ভূপাতিত কালীর দিকে চেয়ে একটা বড় করে দম নিয়ে বিকট গলায় বলে উঠল, “এখন যদি হাঁড়িকাঠে ফেলে মায়ের নামে তোর গলাখানা নামিয়ে দিই তা হলে কী হয়? গুণ্ডামি আর গা-জোয়ারি তা হলে কোথায় থাকবে রে পাষণ্ড? ভাল-ভাল মানুষদের ওপর হামলা করে দুধ আর ইট-সিমেন্ট আদায় করছিস যে বড়, অ্যাঁ! গগন সাঁপুইয়ের টাকা বেশি দেখেছিস?”
কালী উঠল না। উঠলেই বিপদ। শুয়ে-শুয়েই বলল, “টাকা কোথায় গো পীতাম্বরদাদা? সব মোহর।”
কালু একটা রদ্দা তুলেছিল, পীতাম্বরও কড়কে দেবে বলে হাঁ। করেছিল, থেমে গেল দুজনেই। “মোহর!”
কালী এবার উঠে বসে গা থেকে একটু ধুলো ঝেড়ে নিয়ে বলল, “সবই বুঝি গো পীতাম্বরদাদা, দিনকাল খারাপই পড়েছে। নইলে ওই ছুঁচোটার হয়ে এই শস্তার কাজে নামবার লোক তো তোমরা নও। তা কতয় রফা হল গগনের সঙ্গে?”
পীতাম্বর গম্ভীর গলায় বলে, “তা দিয়ে তোর কী দরকার? মুখ সামলে কথা বলবি।”
কালী দুঃখের গলায় বলে, “সে তোমরা না বললেও আন্দাজ করতে কষ্ট নেই। খুব বেশি হলে পাঁচ-সাতশো টাকায় রফা হয়েছে। আর কাল রাতেই কি না পাষণ্ডটা দুশো এগারোখানা মোহর বেমালুম গাপ করে ফেলল ভালমানুষ ছোঁকরাটার কাছ থেকে। ধর্মে সবই সইছে আজকাল হে। দুশো এগারোখানা মোহর গাপ করে সেই ছোঁড়াকে মেরে কোথায় গুম করে ফেলল কে জানে! আমার দোষ হয়েছে কী জানো, মোহরের বৃত্তান্ত আমি জেনে ফেলেছিলাম। সেকথা যাক, দিনকাল খারাপ পড়েছে বুঝতে পারছি, তোমাদের মতো বড়দরের ওস্তাদেরা যখন পাঁচ-সাতশো বা হাজার টাকায় কাজে নামছ তখন আকালই পড়েছে বলা যায়। তবে কি না, মোহরগুলো গগনের ন্যায্য পাওনা নয়। কিন্তু সেকথা তাকে বলবার সাহসটা আছে কার বলো?”
পীতাম্বর কালুর দিকে চেয়ে বলে, “দরটা বড্ড কমই হয়ে গেছে না রে?”
কালু খুব গম্ভীর মুখে বলে, “তোর আক্কেল যে কবে হবে! অত কমে কেন যে এত মেহনত খরচা করলি! চড়প্রতি দশ টাকা করে ধরলে হত।”
পীতাম্বর দুটো হাত ঝেড়ে চাপা গলায় বলে, “যা হয়েছে তা তো হয়েই গেছে। আর একটাও চড় খরচ করার দরকার নেই। বকাঝকাও নয়। বাহান্ন টাকার কাজ আমরা তুলে দিয়েছি।”
কালু বলল, “তার বেশিই হয়ে গেছে।”
পীতাম্বর দুঃখিতভাবে মাথা নাড়ল। তারপর কালীর দিকে চেয়ে বলে, “যাঃ, খুব বেঁচে গেলি আজ। এবার বৃত্তান্তটা একটু খোলসা করে বল তো?”
কালী ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখে চেয়ে বলল, “কী বললে পীতাম্বরদাদা! কানে কি ভুল শুনলুম আমি! বাহান্ন টাকা! মোটে বাহান্ন টাকায় তোমাদের মতো রুস্তম আজকাল হাত নোংরা করছে! এ যে ঘোর কলিকাল পড়ে গেল গো! এতে যে আমারও বেজায় অপমান হয়ে গেল! মাত্র বাহান্ন টাকায় আমার গায়ে হাত তুললে তোমরা!”