গগন জিভ কেটে মোলায়েম হেসে বলে, “ওই অনুরোধটি করবেন না নটবরখুড়ো। চারদিকে শত্রুর কুনজর। এত জোড়া চোখের সামনে আমি এ-জিনিস খুলে দেখাতে পারব না। কাল সকালের দিকে আসবেন, এক ফাঁকে দেখিয়ে দেব’খন। তেমন কিছু নয়, গরিবের বাড়িতে আর কীইবা থাকবে।”
বিজয় মল্লিক আমতা-আমতা করে বললেন, “তবু একবার দেখে নেওয়া ভাল হে গগন। থলিতে অন্য বাড়ির চোরাই জিনিসও তো থাকতে পারে। তখন আবার তুমি ফেঁসে যাবে।”
“যে আজ্ঞে। এখনই দেখে বলছি ধৰ্মত ন্যায্যত আমারই জিনিস কি না। ওরে ভুতো টর্চটা একটু ধর তো থলির মুখটায়।”
ভুতো টর্চ ধরল। গগন সাঁপুই থলির মুখটা একটু ফাঁক করে উঁকি মেরেই বলে উঠল, “নিয্যস আমারই জিনিস বটে মশাইরা। এসবই আমার বুকের রক্ত জল করে জোগাড় করা। ওরে, তোরা ছোঁড়াটার চোখে-মুখে জল দিয়ে লাকড়ির ঘরেই পুরে রাখ।”
ঠিক এই সময়ে ভিড়ের ওদিক থেকে একটা ববববম’ শব্দ উঠল। শব্দটা সকলেরই চেনা। এ হল গে কালী কাপালিক। তবে কি না পেঁয়ো যোগী, ভিখ পায় না, কালী কাপালিককেও এই গঞ্জ এলাকার কেউ বিশেষ মানে না। কালী একসময়ে ছিল কালীচরণ গোপ। বাজারের সত্যচরণের মুদির দোকানে কাজ করত। চুরি ধরা পড়ায় সত্যচরণ তাড়িয়ে দেয়, কালীর বাবা নরহরিও তাকে ত্যজ্যপুতুর করে। কালী না কি তারপর তন্ত্র শিখতে কামাখ্যা চলে যায়। কয়েক বছর হল ফিরেছে। পরনে রক্তাম্বর, মাথায় জটা, মুখে পেল্লায় দাড়ি-গোঁফ। বাড়িতে ঠাঁই হয়নি। এখন বটতলার পুরনো ইটভাটার কাছে আস্তানা গেড়ে আছে। শাগরেদও আছে কয়েকজন। কেউ পাত্তা না দিলেও কালী গঞ্জের সব ব্যাপারেই নাক গলায়। মানুষকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। সে শাপশাপান্ত করে, বাণ-টান মারে, তবে তাতে বিশেষ কারও ক্ষতি হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
ভিড় ঠেলে পেল্লায় চেহারার কালী সামনে এসে দাঁড়াল। কোমরে হাত দিয়ে ভূপতিত চোরের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “হুঁ, সন্ধেবেলাতেই ছোঁড়াকে সাবধান করে বলে দিয়েছিলুম, ওরে আজ অমাবস্যা, তায় তোর গ্রহবৈগুণ্য আছে, আজ বাড়ি যা। তা শুনল না। নিয়তি কেন বাধ্যতে। চন্দ্র-সূর্য এদিক-ওদিক হয়, কিন্তু কালী কাপালিকের কথার নড়চড় হওয়ার জো নেই।”
পটল গাঙ্গুলি ভ্রূ কুঁচকে বলে, “চিনিস নাকি ওকে?”
কালী পটল গাঙ্গুলিকে একটু সমঝে চলে। অনেককাল আগে এই পটল গাঙ্গুলির একটা গোরু নিয়ে খোঁয়াড়ে দিয়ে দু’আনা পয়সা রোজগার করে শিবরাত্রির মেলায় শোনপাপড়ি খেয়েছিল। তার ফলে খুব খড়ম-পেটা হয়েছিল গাঙ্গুলির হাতে। আজও ব্যথাটা কপালের বাঁ ধারে চিনচিন করে। কালী গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, “চিনব কী করে! সন্ধেবেলা এসে আমার আস্তানায় ভিড়ে পড়েছিল। বলছিল, কোথাও যাওয়ার আছে যেন। একটু রাত করে বেরোবে। সন্ধেটা কাটিয়ে যেতে চায়। সঙ্গে ওই একখানা চামড়ার ব্যাগ ছিল।”
পটল গাঙ্গুলি বলে উঠল, “ওই ব্যাগটা কি, দ্যাখ তো।”
কালী গগনের হাতের ব্যাগখানা দেখে বলল, “ওইটেই, ভেতরে বেশ ভারী জিনিস আছে। ঝনঝন শব্দ হচ্ছিল।”
গগন সাঁপুই অমায়িক হাসি হেসে বলল, “ভুল দেখেছ কালী। ব্যাগের মধ্যে তখন জিনিস-টিনিস ছিল না, তবে এখন হয়েছে। ওরে ভুতো, ব্যাগখানা তোর মায়ের হেফাজতে দিয়ে আয় তো!”
ভূতো এসে ব্যাগটা নিয়ে যেতেই বিজয় মল্লিক বলল, “গগন, পুলিশে একটা খবর পাঠানো ভাল।”
গগন মাথা নেড়ে বলে, “যে আজ্ঞে, সকালবেলাতেই ভল্টাকে পাঠিয়ে দেব’খন ফাঁড়িতে। ও নিয়ে ভাববেন না।”
কালী কাপালিক গগনের দিকে স্থির চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে হঠাৎ ফিচিক করে একটু হেসে বলল, “গগনবাবু, তোমার লাল গোরুটা শুনেছি ভাল দুধ দিচ্ছে আজকাল। সকালের দিকে আমার রোজ আধসেরটাক দুধ লাগে। বুঝেছ?”
গগন একটু অবাক হয়ে বলে, “দুধ! হঠাৎ এই মাঝরাতে চোরের গোলমালে দুধের কথা ওঠে কেন রে কালী?”
“ওঠাও বলেই ওঠে। কাল সকাল থেকেই বরাদ্দ রেখো। আমার এক চেলা ঘটি নিয়ে আসবে।”
গগন ঠাট্টার হাসি হেসে বলল, “শোনো কথা! ওরে যা-যা, এখন বিদেয় হ। দুধের কথা পরে ভেবে দেখা যাবে।”
কালী কাপালিক একটা হাঃ হাঃ অট্টহাসি হেসে বলল, “আরও কথা আছে হে গগনচন্দ্র সাঁপুই। ইটভাটার পাশে বটতলার আস্তানাটা অনেকদিন ধরে বাঁধিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে। ভগবান তো তোমায় মেলাই দিয়েছেন। কালী কাপালিকের জন্য এটুকু করলে আখেরে তোমার ভালই হবে। বুঝলে?”
এই চোর ধরার আসরে দুধ আর আস্তানা বাঁধানোর আবদার কালী কেন তুলছে তা কেউ কিছু বুঝতে পারল না। তবে কালীর সাহসটা যে বড় বেড়েছে এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। আগে তো গঞ্জের পুরনো লোকেদের কারও মুখের ওপর এরকম বেয়াদবি গলায় কথা বলত না!
পটল গাঙ্গুলি বেশ চটে গিয়ে বললেন, “ওরে কালী, তোর হঠাৎ হলটা কী? এ যে আরশোলাও হঠাৎ পক্ষী হয়ে উঠল দেখছি!”
গগন সাঁপুই কাতর কণ্ঠে বলল, “দেখুন আপনারাই দেখুন, কী অবিচারটাই না আমার ওপর হচ্ছে। এত বড় একটা চুরির ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই আবার…”।
কালী আরও একটা কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ভিড়ের পেছন থেকে একটা বাজখাই গলা বন্দুকের মতো গর্জে উঠল, “অ্যাই বোকা, দূর হ এখান থেকে!”
গলাটা কালী কাপালিকের পঁচাশি বছর বয়সী বাবা হরনাথের। কালী আজও তার বাপকে যমের মতো ভয় পায়। এক ধমকেই সে সুড়সুড় করে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে একটু চাপাস্বরে গগনকে বলে গেল, “আজ যাচ্ছি, কিন্তু কাল আবার দেখা হবে।”