হরিপদ মোহরগুলো মেঝের ওপর উপুড় ঢেলে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে বলল, “মোট দুশো এগারোখানা আছে, তাই না?”
গগন একখানা শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“এর মধ্যে নানা জাত আর চেহারার মোহর দেখতে পাচ্ছেন তো! কোনওটা তেকোনা, কোনওটা ইংরেজি ‘ডি’ অক্ষরের মতো, কোনওটা ছ’কোনা, কোনওটা পিরামিডের মতো–এগুলোই পুরনো। হাজার-দেড় হাজার বছর আগেকার। এগুলোর দামই সবচেয়ে বেশি। গোলগুলো তো পুরনো নয়, কিন্তু ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এগুলোও কম যায় না। এগুলো যদি গলিয়ে ফেলতেন গগনবাবু, তা হলে যে কী সর্বনাশই না হত।”
“পাগল নাকি! গলানোর কথা আর উচ্চারণও করিস না, খবর্দার।”
হরিপদ মাথা চুলকে বলে, “কিন্তু মুশকিল কী জানেন, এসব যে অতি সাঙ্ঘাতিক মূল্যবান জিনিস?”
“বুঝতে পারছি রে। তা হ্যাঁ রে, দুশো এগারোর সঙ্গে লাখ লাখ গুণ দিলে কত হয়?”
“তার লেখাজোখা নেই গগনবাবু, লেখাজোখা নেই। আর সেইটেই তো হয়েছে মুশকিল।”
গগন তেড়ে উঠে বলে, “কেন, দু’শো এগারোর সঙ্গে লাখ-লাখ গুণ দিতে আবার মুশকিল কিসের? আজকাল তো শুনি গুণ দেওয়ার যন্ত্র
বেরিয়ে গেছে! ক্যারেকটার না ক্যালেন্ডার কী যেন বলে!”
“ক্যালকুলেটার।”
“তবে? ওই যন্ত্র একটা কিনে এনে ঝটপট গুণ দিয়ে ফেলব। মুশকিল কিসের?”
“গুণ তো দেবেন। গুণ দিয়ে কুলও করতে পারবেন না। কিন্তু ৫৮
আমি ভাবছি অন্য কথা। এত টাকার জিনিস আপনার ঘরে আছে জানলে যে এ বাড়িতে ভাগাড়ে শকুন পড়ার মতো দশা হবে! ডাকাতরা দল বেঁধে আসবে যে! কুকুর, বন্দুক, দরোয়ান দিয়ে কি ঠেকাতে পারবেন? গাঁয়ে-গঞ্জে কোটি-কোটি টাকার জিনিস তো মোটেই নিরাপদ নয়।”
গগন চোখ স্থির করে বলে, “কত বললি?”
“কোটি-কোটি।”
“ভুল শুনছি না তো! কোটি-কোটি?”
“বহু কোটি গগনবাবু। আর ভয়ও সেখানেই।”
গগন হঠাৎ আলমারি খুলে একটা মস্ত ভোজালি বের করে ফেলল। তারপর তার মুখ-চোখ গেল একেবারে পালটে। গোলপানা অমায়িক মুখোনা হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠল, চোখে সাপের ক্রুরতা। চাপা গলায় গগন বলে, “মোহরের খবর তুই ছাড়া আর কেউ জানে না। তোকে মেরে পাতালঘরে পুঁতে রেখে দিলেই তো হয়।”
হরিপদ দুপা পেছিয়ে গিয়ে সভয়ে বলে, “আজ্ঞে, আমার কাছ থেকে পাঁচকান হবে না। সে ভয় নেই। কিন্তু আপনারও বুদ্ধির বলিহারি যাই। এই হরিপদ কর্মকার ছাড়া ও-মোহর বেচবেন কী করে? মোহরের সমঝদার পাবেন কোথায়? এ-তল্লাটে তেমন সেকরা একজনও নেই যে, এইসব মোহরের আসল দাম কত তা বলতে পারে। যদিবা শহরে-গঞ্জে কাউকে পেয়েও যান সে আপনাকে বেজায় ঠকিয়ে দেবে বা মোহরের গন্ধ পেয়ে পেছনে গুণ্ডা বদমাশ লেলিয়ে দেবে। কাজটা সহজ নয় গগনবাবু।
গগন সঙ্গে-সঙ্গে ভোজালিটা খাপে ভরে আলমারিতে রেখে একগাল হেসে বলে, “ওরে, রাগ করলি নাকি? আমি তোকে পরীক্ষা করলাম।”
হরিপদ মাথা নেড়ে বলে, “আমার আর পরীক্ষায় কাজ নেই মশাই, ঢের শিক্ষা হয়েছে। আমার পৈতৃক প্রাণের দাম মোহরের চেয়েও বেশি। আমি আপনার কাজ করতে পারব না। এই নিন, আপনার পাঁচ হাজার টাকা ফেরত নিন।”
এই বলে ব্ল্যাক থেকে টাকা বের করে হরিপদ গগনের দিকে ছুঁড়ে দিল।
গগন ভারী লজ্জিত হয়ে বলে, “অমন করিসনি রে হরিপদ। একটা মানুষের মাথাটা একটু হঠাৎ গরম হয়ে উঠেছিল বলে তুই এই বিপদে তাকে ত্যাগ করবি? তুই তো তেমন মানুষ নোস রে।”
“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না। আর বিশ্বাস না করলে এই মোহর হাতবদল করা আপনার কর্ম নয়। পাঁচ হাজার টাকায় তো আর মাথা কিনে নেননি।”
গগনবাবু পুনমূষিক হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে, “দাঁড়া ভাই, দাঁড়া। আমারও মনে হচ্ছিল যেন, পাঁচ হাজার টাকাটা বড্ড কমই হয়ে গেল। তোকে আমি আরও দশ হাজার দিচ্ছি ভাই, আমাকে বিপদে ফেলে যাস না।”
“না মশাই, আপনার ভাবগতিক ভাল ঠেকছে না। এখন ছেড়ে দিচ্ছেন, কিন্তু পরে বিপদে ফেলবেন।”
“আচ্ছা, আরও দশ। মোট পঁচিশ হাজার দিলে হবে? না, তাও গাল উঠছে না তোর? ঠিক আছে, আরও পাঁচ ধরে দিচ্ছি না হয়।”
বলে গগন আলমারি থেকে টাকার বান্ডিল বের করে মোট ত্রিশ হাজার টাকা গুনে দিয়ে বলল, “এবার একটু খুশি হ ভাই। কিন্তু কথা দে, তোর মুখ থেকে মোহরের খবর কাকপক্ষিতেও জানবে না। মা কালীর ফোটোটা ছুঁয়েই বল একবার।”
হরিপদ কালীর ফোটো ছুঁয়ে বলে, “জানবে না। আপনি মোহরগুলো গুনে-গুনে ব্যাগে ভরে আলমারিতে তুলে রাখুন। আলমারির চাবি সাবধানে রাখবেন। আর চারদিকে ভাল করে চোখ রাখা দরকার।”
“তা আর বলতে! তবে বড় ভয়ও ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছিস। আজ রাতে আর ঘুম হবে না যে রে।”
“ঘুম কম হওয়াই ভাল। সজাগ থাকাও দরকার। আমিও বাড়ি গিয়ে একটু ভাবি গে।”
“যা, ভাই যা। ভাল করে ভাব। কত যেন বললি? কোটি-কোটি না
কী যেন! ঠিক শুনেছি তো!”
“ঠিকই শুনেছেন। এবার আমি যাই, দরজাটা খুলে দিন।”
আলমারি বন্ধ করে চাবি টাকে খুঁজে গগন দরজা খুলে দিল।
হরিপদ গগনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা বাজারে গিয়ে চাল, ডাল, তেল, নুন, আনাজ কিনে ফেলল। একশিশি ঘি অবধি। বাড়িতে ফিরে যখন বাজার ঢেলে ফেলল, তখন অধরা অবাক, “এ কী গো! এ যে বিয়ের বাজার!”
“এতদিনে ভগবান বুঝি মুখ তুলে একটু চাইলেন। বেশ ভাল করে রান্নাবান্না করো তো। আমি একটু ঘুরে আসছি।”
“আবার কোথায় যাচ্ছ?”