গগন একটু অবাক হয়ে বলে, “চিড়ে-দইয়ের কথা কী বললি বাপ? ঠিক যেন বুঝতে পারলুম না।”
পীতাম্বর আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কাজ হাতে নিলে আমরা মক্কেলের পয়সায় একটু ফলার করি। ওইটেই রীতি। এর মানে হল, কাজটা আমরা হাতে নিচ্ছি। দুজনের জন্য দু ধামা চিড়ে, দু ডেলা গুড়, সেরটাক দই, আর চারটি পাকা কলা। আর মায়ের পুজোর জন্য পাঁচ সিকে করে দুজনের মোট আড়াই টাকা।
“বাপ রে! তোদের আম্বা বড় কম নয় দেখছি।”
আপনি মশাই এত কেপ্পন কেন বলুন তো! সেই নিকুঞ্জপুর থেকে টেনে এনে তো ছুঁচো মেরে আমাদের হাত গন্ধ করাচ্ছেন। খুনখারাপি, আগুন দেওয়া-টেওয়া বড় কাজ নয়। এইসব কম টাকার কাজ আজকাল আর আমরা করি না। তার ওপর যা দরাদরি লাগিয়েছেন, এ তো পোষাচ্ছে না মশাই।”
“রাগ করিসনি বাপ। চিড়ে-দইয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। পাইক বরকন্দাজ তো আমারও আছে, কিন্তু তারা সব পেঁয়ো যোগী। কালী কাপালিক তাদের মোটেই ভয় খায় না। উলটে চোটপাট করে। কাজটা কিন্তু ভাল করে করা চাই। যেন আর কখনও রা কাড়তে না পারে। মুখ একেবারে বন্ধ করে দিবি।”
গগন হাঁকডাক করে চিড়ে-দই সব আনিয়ে ফেলল। কালু আর পীতাম্বর যখন ফলারে বসেছে তখন কাজের লোক কেষ্ট এসে খবর দিল, হরিপদ কর্মকার এসেছে। গগন শশব্যস্তে বাইরে বেরিয়ে এল।
একগাল হেসে গগন বলল, “এসেছিস ভাই হরিপদ! আয়, বিপদের দিনে তুই ছাড়া আর আমার কে আছে বল? ভেতরে চল ভাই, একটু গোপন শলাপরামর্শ আছে।”
হরিপদকে ঘরে ঢুকিয়ে খিল এটে গগন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “বিপদ যখন আসে তখন চতুর্দিক থেকেই আসে। শুনেছিস তো, কাল রাতে এক সাঙ্ঘাতিক চোর ঢুকেছিল বাড়িতে! সে কী চোর রে বাবা, এইটুকুন বয়স, কিন্তু তার বুদ্ধি আর কেরামতির বলিহারি যাই। দু-দুটো বাঘা কুকুর, পাইক, বাড়িসন্ধু এত লোকজন, মজবুত দরজা-জানলা কিছুই তাকে রুখতে পারেনি। ঘরে ঢুকে সিন্দুক ভেঙে যথাসর্বস্ব নিয়ে পালিয়েই গিয়েছিল প্রায়। মা মঙ্গলচণ্ডীই রক্ষা করেছেন। এ কী দিনকাল পড়ল রে হরিপদ? এ যে বাংলার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা! কলিযুগের শেষদিকটায় নাকি চোর বাটপাড়দের খুব বাড়বাড়ন্ত হবে। তাই হচ্ছে দেখছি। ওদিকে বিজ্ঞানের যা অগ্রগতি হচ্ছে শুনতে পাই সেটাও ভয়েরই ব্যাপার। বিজ্ঞানের কলকাঠি সব চোরদের হাতেই চলে যাচ্ছে বুঝি! নইলে এত লোককে ঘুম পাড়িয়ে নিঃসাড়ে কাজটা যে কী করে সেরে ফেলল, সেইটেই ভেবে পাচ্ছি না। তাই ভাবছি সোনাদানা আর ঘরে রাখা ঠিক নয়। মুকুন্দপুরের বিশু হাজরার চালকলটা কিনব-কিনব করছিলাম, বায়নাপত্তরও হয়ে আছে। বিশু হাজরাও চাপ দিচ্ছে খুব। তাই ভাবছি, আর দেরি নয়, ঘরের সোনার ওপর যখন চোর-ছ্যাচড়ের নজর পড়েছে, তখন ও-জিনিস না রাখাই ভাল। ধানকল তো আর চোরে নিতে পারবে না, কী বলিস?”
হরিপদ কাঁচুমাচু মুখে বলে, “আজ্ঞে, তা তো বটেই।”
গগন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “নেইও বেশি কিছু। ঠাকুরদার আমলের গোটাকয় মোহর। স্মৃতিচিহ্নই একরকম। কতকালের
জিনিস। গঞ্জের শাবলরাম মাড়োয়ারির সঙ্গে কথাও হয়েছে। তবে সে সেয়ানা লোক। বলে কিনা, পুরনো আমলের মোহরে নাকি মেলা ধুলোময়লা ঢুকে থাকত। সত্যি নাকি রে?”
হরিপদ মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে, অতি সত্যি কথা। সে আমলে সোনার শোধনের তেমন ব্যবস্থা ছিল না তো।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গগন বলে, “মাড়োয়ারিও তাই বলছে রে। সে বলেছে, মোহর গলিয়ে শোধন করে খাঁটি সোনার বাট দিলে সে নগদ টাকায় কিনে নেবে। তুই ভাই, চটপট কাজটা করে দে। মাড়োয়ারির পো কাল বাদে পরশুই নাকি দেশে চলে যাবে। তার মেয়ের বিয়ে। সোনাদানার তারও বড় দরকার। তোর জিনিসপত্তর আজই নিয়ে চলে আয়। কোণের ঘরে বসে কাজ করবি।”
হরিপদ একটু উদাস মুখে বলে, “আগে মোহরগুলো তো দেখি।” গগন তার লোহার আলমারি খুলে চমৎকার চামড়ার ব্যাগখানা বার করল। একটু দুঃখী মুখে বলল, “তুই ছাড়া বিশ্বাসী লোকই বা আর পাব কোথায়। কাজটা করে দে, থোক পঞ্চাশটা টাকা দেব’খন। তবে আজ রাতেই কাজ সেরে ফেলা চাই।”
গগন হরিপদর হাতে কয়েকখানা মোহর দিতে সে সেগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল। বিকেলের আলো মরে এসেছে। গগনের ঘরে জানলা-দরজাও বড্ড কম। তবু আবছা আলোতেও সে যা দেখল, তাতে ইন্দ্রর কথায় আর সন্দেহ নেই। সে গগনের দিকে চেয়ে বলে, “গগনবাবু, যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলি।”
“অভয় মানে! তোর আবার ভয়ের আছেটা কী?”
“বলছি, এ-মোহর গলিয়ে আপনি যা সোনা পাবেন, সেটা এমন কিছু নয়। পান অনেক বাদ যাবে। কিন্তু.”
গগন ব্যগ্র গলায় বলে, “কিন্তুটা আবার কী রে?”
“ভাবছি ভগবান যাকে দেন তাকে ছপ্পড় ফুড়েই বুঝি দেন। আপনার কপালটা খুবই ভাল।”
গগনের মুখে একটা লোভনীয় ভাব জেগে উঠলেও মনের ভাব চেপে রেখে সে গম্ভীর হয়ে বলে, “কপালের কথা বলছিস হরিপদ! ঘরের সোনা বেরিয়ে যাচ্ছে, আর বলছিস ভগবান ছল্পর ছুঁড়ে দিচ্ছেন! এত দুঃখেও বুঝি আমার হাসিই পাচ্ছে। তা হ্যাঁ রে হরিপদ, একটু ঝেড়ে কাসবি বাবা? তাপিত এ প্রাণটা জুড়োবার মতো কোনও লক্ষণ কি দেখছিস রে ভাই? মেঘের কোলে কি আবার কোনওদিন রোদ হাসবে রে?”
হরিপদ মাথা নেড়ে বলে, “বলে লাভ কী গগনবাবু? গরিবের কথায় আপনার হয়তো প্রত্যয় হবে না। পেটের দায়ে উঞ্ছবৃত্তি করে করে মানুষ হিসাবে আমাদের দামই কমে গেছে।”