মা অবশ্য রাগলেন না। অলঙ্কারের রোগামতো মা কুয়োর ধারে কাপড় কাঁচতে বসেছেন। অলঙ্কারের সঙ্গে ছেলেটাকে আসতে দেখে কাঁচা থামিয়ে অবাক হয়ে চাইলেন।
অলঙ্কার ভয়ে-ভয়ে বলল, “মা, এর সব চুরি হয়ে গেছে। জঙ্গলে পড়ে ছিলেন।”
অলঙ্কারের মা অধরা উঠে মাথায় একটু ঘোমটা টেনে বললেন, “এ তো বড় ঘরের ছেলে মনে হচ্ছে! যাও বাবা, দাওয়ায় গিয়ে বোসো। ওরে অলঙ্কার, চটের আসনটা পেতে দে তো!”
মায়ের এই কথাটুকুতেই অলঙ্কারের বুক আনন্দে ভেসে গেল। মাকে সে যত রাগী আর বদমেজাজি ভাবে ততটা নন তা হলে! সে তাড়াতাড়ি আসন পেতে বসতে দিল ছেলেটাকে। চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল, “আপনার নাম কিন্তু বলেননি।”
“আমার নাম ইন্দ্রজিৎ রায়।”
“ইন্দ্ৰদা, আমাদের বাড়িতে কিন্তু আপনার খুব অসুবিধে হবে।”
ইন্দ্র মাথা নেড়ে বলে, “অসুবিধে তোমাদেরই হবে বোধ হয়। তবে আমি এ-গাঁয়ে বেশিক্ষণ থাকব না। একটু জিরিয়ে নিয়েই চলে যাব। আগে একটু জল দাও।”
ইন্দ্র প্রায় আধঘটি জল খেয়ে নিল। অধরা দুটো বাতাসা এনে বললেন, “এ-দুটো খাও বাবা। মনে হচ্ছে খুব খিদে পেয়েছে।”
বাতাসা দুটো কচমচিয়ে খেয়ে ইন্দ্র বলল, “এখন খিদেটা সহ্যের মধ্যে এসে গেছে।”
“তবে আর-একটু সহ্য করো বাবা! আমি কচুসেদ্ধ দিয়ে ভাত বসাচ্ছি। আর হিঞ্চের ঝোল। দুটি গরম ভাত খাও।”
“কিন্তু আমি যে আর বেশিক্ষণ এখানে থাকব না মাসিমা। আমাকে চলে যেতে হবে।”
অধরা করুণ চোখে ছেলেটার দিকে চেয়ে বললেন, “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, খুব দুর্বল। এ-শরীরে কি হাঁটতে পারবে? দুটি খেয়ে নিলে গায়ে একটু জোর পেতে।”
ইন্দ্র সভয়ে মাথা নেড়ে বলে, “না, দেরি হয়ে যাবে। না পালালে আমার রক্ষে নেই।”
“তুমি কি ভয় পেয়েছ বাবা?”
ইন্দ্র নীরবে মাথা নেড়ে জানাল যে, সে ভয় পেয়েছে।
অধরা কী বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক এমন সময়ে বাইরে থেকে একটা ভারী গলার হাঁক শোনা গেল, “বলি ও হরিপদ, বাড়ি আছিস? হরিপদ-ও-ও …”
অলঙ্কার শখ করে জঙ্গল থেকে একটা নতুন ধরনের ফণিমনসা এনে উঠোনের বেড়া হবে বলে লাগিয়েছিল। সেগুলো এখন বুকমান বেড়ে উঠে প্রায় নিচ্ছিদ্র এক আড়াল তৈরি করেছে। বাইরে থেকে উঠোনটা আর কারও নজরে পড়ে না। লোকটাকে দেখা গেল না বটে, কিন্তু গলা শুনে অধরা আর অলঙ্কারের মুখ শুকোল।
ইন্দ্র চকিতে মুখ তুলে বলল, “লোকটা কে বলো তো!”
অলঙ্কার ম্লানমুখে বলে, “ও হচ্ছে হরিশ সামন্ত। গগন সাঁপুইয়ের খাজাঞ্চি। তাগাদায় এসেছে।”
“গগন সাঁপুই!” বলে ইন্দ্র ভু কোঁচকাল। তারপর টপ করে উঠে ঘরে ঢুকে কপাটের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। হরিশ সামন্ত ততক্ষণে ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, পাশে শম্ভু পাইক।
অধরা ইন্দ্রর কাণ্ড নীরবে দেখলেন, কিন্তু কোনও ভাবান্তর হল না। হরিশের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বললেন, “উনি তো বাড়ি নেই।”
হরিশ একটু খেচিয়ে উঠে বলে, “যখনই আসি তখনই শুনি বাড়ি নেই! সাতসকালে গেল কোন চুলোয়? যাকগে সে এলে বোলো বাবু এত্তেলা দিয়েছেন। এবেলাই গিয়ে যেন একবার হুজুরের কাছে গিয়ে হাজির হয়। সুদে-আসলে তার মেলা টাকা বাকি পড়েছে। বুঝলে?”
“বুঝেছি। এলে বলব’খন।”
“আর-একটা কথা। মন দিয়ে শোনো। আজ আদায় উশুলের জন্য আসা নয়। বাবুর একটা জরুরি কাজ করে দিতে হবে। ভয় খেয়ে যেন আবার গা-ঢাকা না দেয়। বরং কাজটা করে দিলে কিছু পেয়েও যাবে। বুঝলে?”
“বুঝেছি।”
হরিশ সামন্ত চলে যাওয়ার পর ইন্দ্র বেরিয়ে এল। তার মুখে-চোখে আতঙ্কের গভীর ছাপ। সে অলঙ্কারকে জিজ্ঞেস করল, “কী কাজের জন্য তোমার বাবাকে খুঁজছে ওরা?”
ঠোঁট উলটে অলঙ্কার বলে, “কে জানে! তবে বাবার তো সোনার দোকান ছিল, গয়না বানাতেন। এখন আর ব্যবসা ভাল চলে না। গগনজ্যাঠা মাঝে-মাঝে সোনা গলানোর জন্য বাবাকে ডাকেন।”
ইন্দ্রর মুখ থেকে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত যেন সরে গেল। সাদা ফ্যাকাসে মুখে সে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল শুন্য দৃষ্টিতে। তারপর বিড়বিড় করে বলল, “গলিয়ে ফেলবে! গলিয়ে ফেলবে!”
অধরা একদৃষ্টে দেখছিলেন ইন্দ্রকে। হঠাৎ একটু হেসে বললেন, “শোনো বাবা ইন্দ্র, তুমি অত ভয় পেয়ো না। ওপাশে একটা পুকুর আছে। ভাল করে স্নান করে এসো তো। তারপর খেয়ে একটু ঘুমোও। তোমার কোনও ভয় নেই। মাথা ঠাণ্ডা না করলে মাথায় বুদ্ধি আসবে কেমন করে?”
ইন্দ্র মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু ওরা যে আমার সব মোহর গলিয়ে ফেলবে!”
অধরা অবাক হয়ে বলেন, “তোমার মোহর? মোহর তুমি কোথায় পেলে বাবা? আর তা গগনবাবুর কাছেই বা গেল কী করে?”
“সে কথা বলতে অনেক সময় লাগবে।”
“তবে এখন থাক। আগে স্নান-খাওয়া হোক। তারপর কথা।”
“কিন্তু ততক্ষণে…”
অধরা মাথা নেড়ে বললেন, “ভয় নেই। সোনা যাতে না গলে তার ব্যবস্থা হবে। এ-গাঁয়ে স্বর্ণকার মাত্র একজন, সে ওই অলঙ্কারের বাবা। তিনি না গেলে ও সোনা গলবে না।”
ইন্দ্ৰ বেজার মুখে খানিকক্ষণ বসে রইল। অলঙ্কারই তাকে ঠেলে তুলে পুকুর থেকে স্নান করিয়ে আনল। দুশ্চিন্তায়, উদ্বেগে ভাল করে ভাত খেতে পারল না সে। বোধ হয় এসব সামান্য খাবার খাওয়ার অভ্যাসও নেই।
দুপুরে হরিপদ ফিরে ঘরে অতিথি দেখে অবাক। তবে অলঙ্কার যা ভয় করছিল তা কিন্তু হল না। হরিপদ রেগেও গেলেন না, বিরক্তও হলেন না। আবার যে খুশি হলেন, তাও নয়। অধরা বললেন, “ও ছেলেটি সম্পর্কে সব বুঝিয়ে বলছি। তুমি আগে স্নান-খাওয়া করে নাও।”