- বইয়ের নামঃ ছায়াময়
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. পেশকার গগন সাঁপুইয়ের বাড়িতে
ছায়াময় – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পেশকার গগন সাঁপুইয়ের বাড়িতে মাঝরাতে এক চোর ধরা পড়ল। চোরকে চোর, তার ওপর আবার আহাম্মকও। পালানোর অনেক পথ ছিল। সাঁপুইবাড়ি হচ্ছে শিমুলগড় গাঁয়ের পুবপ্রান্তে, তারপরই দিক-দিগন্ত খোলা। মাঠ-ময়দান-জঙ্গল-জলা। কে খুঁজতে যেত সেখানে! তা না করে আহাম্মকটা গগন সাঁইয়ের লাকড়ির ঘরে সেঁদিয়ে বসে ছিল।
এক হিসাবে চোরটাকে ভালই বলতে হবে। গুলিবন্দুক, ছোরা-ছুরি বা লাঠি-সোটা বের করেনি, সেসব ছিলও না তার কাছে। দুরবস্থায় পড়েছে–তাই দেখলেই বোঝা যায়। গায়ে একটা নীল ছেঁড়া হাফশার্ট, আর পরনে একখানা তালিমারা পাতলুন। পায়ে ফুটোফাটা একজোড়া কেস জুতো। দুহাতে একখানা চামড়ার থলি জাপটে ধরে বসে ছিল।
গগনের বন্দুক আছে, গোটা কয়েক পাইক আছে, তিন-তিনটে জোয়ান ছেলে আছে, দুটো বাঘা দিশি সড়ালে কুকুর আছে। আহাম্মক
হলে সাঁপুইবাড়িতে চোর ঢোকে কখনও? মাঝরাতে চেঁচামেচি শুনে গাঁয়ের লোক জড়ো হল। তবে বাইরের লোকের সাহায্য দরকার হল না। গগনের পাইকরাই লাকড়ির ঘর থেকে চোরটাকে টেনে বের করল।
গাঁয়ের মাতব্বরদের দেখে গগন আপ্যায়ন করে বলল, “আসুন, আসুন, আপনারা। দেশের অরাজকতাটা একবার স্বচক্ষে দেখে যান। এই সুভাষ বোস, গান্ধীজি, সি. আর. দাশ, মাইকেল, মাতঙ্গিনী হাজরা, রবি ঠাকুরের দেশের কী হাল হয়েছে দেখুন। আইন শৃঙ্খলার কী নিদারুণ অবনতি; এ যে দিনে ডাকাতি! এ যে পুকুরচুরি! তবে যাঁ, ধর্মের কল আজও বাতাসে নড়ে। যেমন কর্ম তেমন ফল–মহাকবির এই বাণী আজও মিথ্যে হয়ে যায়নি। বাতাসে কান পাতলে আজও শুনতে পাবেন ভগবানের দৈববাণী, “সাধু সাবধান! সাধু সাবধান!”
পটল গাঙ্গুলি বিচক্ষণ মানুষ, গঞ্জের সবাই খুব মানে। উঠোনের ওপর গগনের এগিয়ে দেওয়া কাঠের চেয়ারে জুত করে বসে হ্যাঁজাকের আলোয় চোরটাকে ভাল করে দেখলেন। নিতান্তই অল্প বয়স। কুড়ি বাইশের বেশি হবে না। চেহারাটা একসময়ে হয়তো মন্দ ছিল না, কিন্তু অভাবে-কষ্টে একেবারে চিমসে মেরে গেছে। গাল বসা, চোখের কোলে কালি। পটল বললেন, “ও গগন, তা চোরে তোমার নিল কী?”
“সেসব তো এখনও হিসাব কষে মিলিয়ে দেখা হয়নি। তবে একটা থলি দেখতে পাচ্ছি।”
“থলিতে কী আছে?”
গগন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “কী আর থাকবে। গরিবের যথাসর্বস্ব। যা কিছু তিল তিল করে জমিয়ে তুলেছিলাম, বুকের বিন্দু-বিন্দু রক্ত জল করে আমার দুধের বাছাদের জন্য যে খুদকুঁড়োর ব্যবস্থা রেখে যেতে চেয়েছিলাম, তার সবটুকুই তো ওই থলিতে। হকের ধন মেসো, ধর্মের রোজগার, তাই ব্যাটা পালাতে পারেনি।”
নটবর ঘোষ একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “থলিটা রেখেছিলে কোথায়?”
গগন মাথা নেড়ে বলল, “থলি আমার নয়। দামি চামড়ার জিনিস। মনে হচ্ছে, ছোঁড়া থলিটা কোনও বাড়ি থেকে চুরি করে এনেছে।”
হেডসার বিজয় মল্লিক বললেন, “কী-কী চুরি গেছে তা কি হিসাব করে দেখেছ?”
গগন মাথা নেড়ে বলে, “দেখার সময় পেলুম কই! যা-কিছু সরিয়েছে তা ওই থলির মধ্যেই আছে মনে হয়। তবে সঙ্গে কোনও শাগরেদ ছিল কি না বলতে পারি না। যদি তার হাত দিয়ে কিছু চালান করে দিয়ে থাকে তবে আলাদা কথা। সেসবও হিসাব করে খতিয়ে দেখতে হবে।”
গগনের লোকেরা আরও দুটো হ্যাঁজাক জ্বেলে নিয়ে এল। বিয়েবাড়ির মতো রোসনাই হল তাতে। সেই আলোয় দেখা গেল, চোর-ছেলেটা ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। মুখে বাক্য নেই। দুটো পাইক বাঘা হাতে তার দুটো কনুইয়ের কাছে চেপে ধরে আছে। হুকুম পেলেই তারা ছোঁড়ার ওপর ডলাইমলাই,রদ্দা-কিল শুরু করতে পারে।
তার সুযোগও এসে গেল হঠাৎ। বলা নেই কওয়া নেই, রোগা চোরটা হঠাৎ হাঁচোড়পাঁচোড় করে পাইক দুটোর হাত ছাড়িয়ে ঝটকা মেরে পালানোর ক্ষীণ একটা চেষ্টা করল যেন। পারবে কেন? পাইক দুটোর বজ্রমুষ্টি ছাড়ানোর সাধ্যই তার ছিল না, আর ছাড়ালেও চারদিকে ত্রিশ-চল্লিশজন মানুষের বেড়া ভেদ করবেই বা সে কী করে? তার এই বেয়াদবিতে পাইক দুটো দুদিক থেকে তার কোমরে আর পিঠে এমন দুখানা হাঁটুর গুতো দিল যে, ছোঁকরা ককিয়ে উঠে যন্ত্রণায় বসে পড়ল মাটিতে। পাইক দুটো এত অল্পে খুশি নয়, তারা দুদিক থেকে পর-পর কখানা রদ্দা বসাল তার ঘাড়ে। ছোঁক একেবারেই নেতিয়ে পড়ল না এবার। চোখ উলটে গোঁ-গোঁ করতে লাগল।
গগন সাঁপুই শশব্যস্তে বলল, “ওরে করিস কী? থাক, থাক, মারধোর করিসনি। চোর ধরা আমাদের কাজ বটে, কিন্তু তার বিচার আর শাসনের ভার আমাদের ওপর নেই রে বাবা। সেসব সরকারবাহাদুর বুঝবেন, আর বুঝবেন গাঁয়ের মোড়লরা। আমাদের কী দরকার পাপের বোঝা ভারী করে? গাঁয়ের মান্যগণ্য মানুষেরা এসেছেন, পরিস্থিতিটা তাঁদের বিচার করতে দে।”
বলতে বলতে গগন সাঁপুই সংজ্ঞাহীন ছেলেটির শিথিল হাতের বাঁধন থেকে অতি সাবধানে থলিটা তুলে নিল। বেশ ভারী থলি। গগনেরও বেশ কসরত করতে হল থলিখানা তুলে নিতে। থলির ভেতরে ধাতব জিনিসের ঝনৎকার শুনে নটবর ঘোষ কৌতূহলী হয়ে বলে উঠল, “দেখি-দেখি, কী আছে থলিতে।”