লোকটা তেজী গলায় বলে, “থাকবে না মানে? সোনামুগের ডাল একেবারে গরমাগরম ঢেলে দেওয়া হবে ভাতের মাথায়। সঙ্গে ফুলকপি ভাজা, মটর শাকের ঘণ্ট, মাছের ঝোল, শেষ পাতে গোরুর দুধ, তাতে আবার পুরু সর।”
অভয় যেন নিজের দুই কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। বলল, “অত দরকার নেই।”
“না, না, দরকার থাকবে না কেন? গাঁয়ে এতকাল পরে একজন অতিথি এলেন, তার সৎকার ভালমতো করতে হবে না? কী বলেন?”
‘সকার’ শব্দটা খট করে লাগল অভয়ের কানে। তবে সে আর ওটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। সকার কথাটার ভাল মানেও আছে। হাঁটতে হাঁটতে গাঁয়ের মাঝ বরাবর চলে এল তারা। দুটো পুকুর এবং আর-একটা বাঁশঝাড় পেরোতে হয়েছে। তারপর একটা মস্ত উঠোনওলা বাড়ি। লোকটা আগল ঠেলে বলদ তাড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আসুন, আসুন, লজ্জা করবেন না। এই হল আমার বাড়ি। ওরে, অতিথি এয়েছে মহামান্য অতিথি, তোরা একটা মোড়া বা জলচৌকি দে তো। তারপর পাদ্যঅর্ঘ্য দে।”
আপ্যায়নটা বড় বাড়াবাড়ি ঠেকছে অভয়ের কাছে। এতটা কেউ করে নাকি?
জলচৌকি, মোড়া বা পাদ্যঅর্ঘ্য কোনওটাই অবশ্য এল না। লোকটা গোয়ালঘরের দিকে যেতে-যেতে মুখ ফিরিয়ে বলল, “বাবুমশাই, ওই দাওয়াতেই একটু চেপে বসুন। আমি বলদ দুটোকে জাবনাটা দিয়েই এলুম বলে। তারপর দেখবেন কেমন যত্নআত্তি করি।”
দাওয়ায় একটা টেমি জ্বলছে। লোকজন বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। তবে দু-একজন মহিলা উঁকিঝুঁকি দিয়েই আড়ালে সরে গেলেন। রান্নাঘর থেকে ভাত ফুটবার গন্ধ আসছে। ডালে সম্বরা দেওয়ারও একটা ছ্যাঁক শব্দ এল। অভয় শরীরের ব্যথা আর ক্লান্তি ভুলে আকুল হয়ে বাতাস শুকতে লাগল। আঃ, কী সুবাস! পেটে খিদেটাও যেন একেবারে উথলে উঠল।
বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকবার পরও লোকটার দেখা পাওয়া গেল না। ভাতের খিদে চাগাড় দিচ্ছে। জলতেষ্টাও আর সহ্য করা যাচ্ছে না। উঠোনের এককোণে ইদারা আর দড়িবাধা বালতি দেখতে পেয়ে অভয় নিজেই উঠে গেল। জল তুলে-তুলে প্রাণভরে খেল। জলের যে এত স্বাদ, তা যেন জানা ছিল না এতকাল। মুখে-ঘাড়ে জল দিয়ে বড় আরামও হল। গাঁয়ের লোকেরা সাঁঝরাতেই খেয়ে নেয় বলে সে শুনেছে। তাই আশা হল, এরাও বোধ হয় এখনই খেতে ডাকবে।
দাওয়ায় বসে এসব ভাবতে-ভাবতে ক্লান্তিতে আবার একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল অভয়ের। হঠাৎ একটা প্রবল চিৎকারে চমকে চাইল।
“ওরে! এই তো সেই! এই তো কুঞ্জখুডোর বাড়ির সেই ডাকাত! এই তো আজ সকালে আমাদের তাড়া খেয়ে মনসাপোঁতার জঙ্গলে সিঁধিয়েছিল!”
অভয় অবাক হয়ে দেখল, সামনে তাকে ঘিরে লাঠিসোঁটা নিয়ে অন্তত চোদ্দ-পনেরো জন লোক। অন্তত চার-পাঁচটা হ্যারিকেন জ্বলছে। একটা মশালও। সামনের ভিড়ে সকালের সেই দুটি চাষিকেও চিনতে পারল অভয়। ভয়ে সে সিঁটিয়ে গেল।
বাড়ির মালিক একটু ফিচিক হাসি হেসে বলল, “ব্যাটা যখন গাঁয়ের নামটাই বলতে পারল না তখনই বুঝেছি এব্যাটা সাঙ্ঘাতিক লোক। আগেই তোমাদের বলে দিচ্ছি ভাই, কুঞ্জখুড়োর পঞ্চাশ হাজারের মধ্যে আমি বেশি চাইব না, দশটি হাজার কিন্তু আমার চাই। নইলে এ-ডাকাত আমি হাতছাড়া করব না।”
জগা বলল, “ভাগ-বাঁটোয়ারার কথা পরে হবে। আগে কুঞ্জখুড়োর কাছে খবরটা তো পাঠাতে হয়। নইলে ওই পেটমোটা দারোগা এসে আসামিও নিয়ে যাবে, প্রাইজও।”
নেতাই বলল, “তোরা আহাম্মক আছিস বাপু। ওরে, চোরাই মাল উদ্ধার না হলে কুঞ্জখুড়ো ট্যাঁক থেকে ফস করে টাকাটা দিয়ে ফেলবে ভেবেছিস? এর মুখ থেকে কথা বের করতে হবে না আগে? দলে কে কে ছিল, চোরাই মাল কার কাছে আছে সেসব আগে জেনে নে। তারপর মাল উদ্ধার করে দিতে হবে না? বলি মাথায় আছে সেসব কথা? অক্ষয়, কী বলল হে?”
কথাটা যে ন্যায্য, সেটা সবাই স্বীকার করল। অক্ষয় হল বাড়ির মালিকের নাম। সে বলল, “তোমার কথা কখনও ফেলনা নয়। এখন বাঁশডলা দিয়ে বিছুটি লাগিয়ে এর পেট থেকে কথা বের করতে হবে।”
একজন ভিতু ও সরল গ্রামবাসী বলে উঠল, “ও অক্ষয়দা, এর কাছে আবার অস্তর নেই তো?”
অক্ষয় বলে, “থাকতে পারে। তবে কজনকে আর মারবে? বল্লমে গেঁথে ফেলব না! ওরে ও জগা, দ্যাখ তো কোমরে পিস্তল ভোজালি কিছু আছে কি না?”
ছিল না। থাকার কথাও নয়। জগা হাতিয়ে দেখে নিয়ে বলে, “নেই। বোধ হয় জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে ভয়ে।”
অভয় হঠাৎ বুঝতে পারল, গরম-গরম ডালভাত জোটার আর কোনও সম্ভাবনা নেই। এবার যা জুটবে তা সইতে পারার ক্ষমতাও তার নেই। সে জীবনে মারধর খায়নি। অভয় তাই আচমকা উঠেই একটা দৌড় লাগাল।
কিন্তু সেটাই ভুল হয়েছিল। এই চক্রব্যুহ ভেদ করা যে অসাধ্য কাজ তা বুঝতে পারেনি। ছুটতে শুরু মাত্র দু-তিনটে লাঠি দমাদম তার পিঠে, মাথায় আর কাঁধে এসে পড়তে লাগল। পায়ে লাঠি দিয়েই কে যেন ল্যাং মেরে ফেলে দিল তাকে। আরও দু-চার ঘা পড়তেই চোখ অন্ধকার হয়ে গেল তার।
যখন চোখ মেলল, তখন তাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে লোক।
জগা বলল, “কুঞ্জখুড়ো, ভাল করে দ্যাখো, এই লোকটাই কিনা?”
গায়ে তুষের চাঁদর-জড়ানো আর সাদা গোঁফওলা একটা লোক
হ্যারিকেন তুলে অভয়ের মুখোনা দেখে নিয়ে বলল, “ধরেছিস ঠিকই বাপ। তবে এ কবুল করলে হয়। মাল উদ্ধার না হলে কিন্তু আমি টাকা দিচ্ছি না।”
“উদ্ধার হবে না মানে! পেট থেকে কী করে কথা বের করতে হয় তা আমরা জানি।”