“ভাল আদমি বাবুজি।”
“তোর কাছে দেখছি সবাই ভাল! এ-লোকটা চালাক, না বোকা? সাহসী, না ভিতু?”
“ভিতু আছে, একটু বুন্ধু-ভি আছে।”
“দরকার পড়লে বোকা সাজতে পারে তো! তা হলেই হবে। এখন যা।”
৩. অভয়ের ঘুম যখন ভাঙল
অভয়ের ঘুম যখন ভাঙল তখন সন্ধে। ঘুমের ঘোরে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। ধড়মড় করে উঠে বসে চারদিকে চেয়ে হাঁ হয়ে গেল। এখানে যে কি করে এল, কেন এল তা ঘুমজড়ানো চোখে প্রথমটায় কিছুতেই বুঝতে পারল না। তারপর হঠাৎ ঝাঁ করে সব মনে পড়ে গেল। আতঙ্কিত চোখে চারদিকে চাইল সে। চারদিকে ধীরে-ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠছে। ঝিঝি ডাকছে। মিটমিট করছে জোনাকি পোকা।
অভয় টের পেল তার যেমন প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছে তেমনই দাউদাউ খিদে। ছোটখাটো খিদেই অভয়ের সহ্য হয় না, আর এ তো বড় খিদে। এই জঙ্গলের মধ্যে খিদেতেষ্টা কোনওটারই কোনও সমাধান পাওয়া যাবে বলে ভরসা হল না অভয়ের। তার ওপর অন্ধকার হয়ে আসছে। একঝাঁক শেয়ালও কাছেপিঠে ডেকে উঠল।
এরকম গা-ছমছমে পরিস্থিতিতে কখনও পড়তে হয়নি অভয়কে। সে শহুরে মানুষ। সে জন্তু-জানোয়ার, সাপ-বিছে, ভূত-প্রেত ইত্যাদিকে ভীষণ ভয় খায়। এই জঙ্গলে যদি রাত কাটাতে হয় তা হলে ভয়েই মরে যাবে অভয়।
সে টপ করে উঠে পড়ল। এবং উঠতে গিয়েই টের পেল তার সবাঙ্গে হাজারটা বিষফোড়ার যন্ত্রণা। অভয় জীবনে কখনও দৌড়ঝাঁপ করেনি, ব্যায়াম করেনি, তার থলথলে আদুরে শরীর। সেই শরীর নিয়ে আজ সকালে যে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে তাতে ৩৮
যন্ত্রণা তো তুচ্ছ, মরেই যাওয়ার কথা।
হাঁটতে গিয়ে দেখল, মাথায় খচখচ করে এমন ব্যথা উঠছে যে, দুপা হাঁটতে গেলে তিন মিনিট দম নিতে হয়। কিন্তু প্রাণের ভয় বড় ভয়। অভয় তার শরীরটাকে একরকম টানতে টানতে হ্যাঁচড়াতে-হ্যাঁচড়াতে নিয়ে চলতে লাগল। জঙ্গলের বেশি ভেতরে সে ঢোকেনি, বাইরেটা দেখাও যাচ্ছে। অভয় সুতরাং খুব উৎসাহ নিয়ে পায়ে-পায়ে এগোতে লাগল। কাছেই গ্রাম আছে, সেখানে গিয়ে পড়লে লোকে বোধ হয় ফেলবে না।
বাইরে বেরিয়ে এসে অভয় একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ছাড়ল। সামনেই একটা অশ্বথ গাছ। তার পাশ দিয়ে আবছা অন্ধকারেও একটা পায়ে-হাঁটা পথ দেখা যাচ্ছে। ও পথ ধরে একটু এগোলেই গ্রাম।
অভয় প্রাণপণে এগোতে লাগল। শরীরের ব্যথা আর হাঁটার ধকলে এই শীতেও তার ঘাম হতে লাগল। হাঁফ ধরে গেল। মাথা ভোঁ-ভোঁ করে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল।
তবু হাল ছাড়ল না অভয়। পৈতৃক প্রাণটা বাঁচাতে কোনওরকমে এখন তাকে লোকালয়ে পৌঁছতেই হবে।
একটা বাঁশবন পেরিয়ে রাস্তাটা একটা বাঁক খেয়ে গাঁয়ের মধ্যে ঢুকেছে। হারিকেন বা কুপির আলো দেখা যাচ্ছে এদিক-সেদিক। বাচ্চাদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। গোরুর গলার ঘণ্টা বাজছে। একটা ছাগলও যেন ম্যা করে উঠল। এসব শুনে আর দেখে ভারী ভাল লাগতে লাগল অভয়ের।
একটা লোক দুটো বলদ তাড়িয়ে ফিরছিল, কাঁধে লাঙল, অভয় তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে বলল, “আচ্ছা ভাই, এ-গাঁয়ের মোড়ল-মশাইয়ের বাড়িটা কোনদিকে?”
লোকটা অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, “এ-গাঁয়ে সবাই
মোড়ল। তা মোড়লকে কিসের দরকার আপনার?”
অভয় কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “এ-গাঁয়ের খুব নাম শুনেছি কিনা, তাই দেখতে আসা।”
লোকটা বলদের লেজে একটা মোচড় দিয়ে জিভে একটা বিকট ট-ডু-ডু-ড আওয়াজ তুলে অভয়কে খুব চমকে দিল। তারপর খুব অবাক হয়ে বলল, “এ-গাঁয়ের নাম শুনেছেন! এমন আশ্চর্য কথা আর কারও মুখে জন্মে শুনিনি। তা এ-গাঁয়ের নামটি কী বলুন তো।”
অভয় নামটা সকালে বোধ হয় একবার শুনেছিল। কিন্তু এখন তার মাথা বেবাক ফরসা। কিছুই মনে নেই। সে আমতা-আমতা করে বলল, “খুবই ভাল নাম আপনাদের গাঁয়ের। কিন্তু নামটা আমার পেটে আসছে, মুখে আসছে না।”
“অ। তা ভাল। এই গাঁয়েই কি আজ দেহরক্ষা করার ইচ্ছে?”
অভয় আঁতকে উঠে বলে, “তার মানে?”
“বলছি এ-গাঁয়েই কি রাতটা কাটাবেন?”
“তা বটে। কিন্তু দেক্ষা করার কথা বলছেন কেন? দেহরক্ষা মানে তো পটল তোলা!”
লোকটা এবার অন্ধকারেও সাদা দাঁত দেখিয়ে এক পলক হেসে বলে, “ওই হল। আমরা মুখসুখ মানুষ, কত ভুলভাল বলি। একটু ঘষেমেজে নেবেন। তা আপনার কোনও অসুবিধে হবে না এখানে। দিব্যি থাকবেন।”
অভয় আশার আলো দেখতে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বলে, “আঃ, বাঁচালেন। আজ বড্ড ধকল গেছে কিনা। খিদেতেষ্টায় প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত।”
লোকটা ফ্যাচ করে হেসে বলে, “তা আপনাকে ন্যাংচাতে দেখেই বুঝেছি। ধকলটা গেল কিসে? কেউ তাড়াটাড়া করেছিল নাকি?”
“যা বলেছেন। এখানকার লোকগুলো যেন কেমনধারা। সত্যি কথা বললেও বিশ্বাস করতে চায় না।”
লোকটা খুব বুঝদারের মতো বলে, “কথাটা সত্যি, এদিককার লোক বিশেষ সুবিধের নয়। তবে আর চিন্তা নেই, আপনি ঠিক জায়গাটিতেই এসে পড়েছেন। একেবারে সিংহের গুহায়।”
অভয় ফের আঁতকে উঠে বলে, “তার মানে?” লোকটা ফের ফ্যাচ করে হেসে বলে, “মুখ-সুখ মানুষ আমরা কী বলতে কী বলে ফেলেছি। ওসব ধরবেন না। আমরা খুব যত্নআত্তি করব আপনার, কিছু ভাবতে হবে না। আমরা একটু মোটা চালের ভাত খাই। মোটা রাঙা মিঠে ভাত। মোটা চালের ভাত চলবে তো আপনার?”
ভাতের কথায় অভয়ের চোখে জল এল, বলল, “খুব চলবে। কতকাল যে ভাত খাইনি মনে হচ্ছে। সঙ্গে ডাল থাকবে তো!”