এদের সদার বলে যাকে মনে হচ্ছিল সেই লম্বা-চওড়া লোকটা সতীশের দিকে চেয়ে বলল, “আমরা একজন ভয়ঙ্কর অপরাধীর খোঁজে এখানে এসেছি। লোকটা কয়েকদিন আগে একটা খুন করে পালিয়ে এসেছে। আমরা খবর রাখি, সে এদিকেই এসেছে। সম্ভবত এখানেই কোথাও তার পৈতৃক বাড়ি ছিল।”
সতীশ তটস্থ হয়ে বলে, “লোকটার চেহারা কেমন বলুন তো! কালো মতো? একটু থলথলে? মুখে একটা ভালমানুষী ভাব?”
চারজন নিজেদের মধ্যে একটু দৃষ্টি-বিনিময় করে নিয়ে বলল, “ঠিক মিলে গেছে। লোকটার চেহারা দেখে ভুল বুঝবেন না। সে মোটেই ভালমানুষ নয়।”
সতীশ মাথা নেড়ে বলে, “সে আমি খুব জানি। লোকটা অন্যের মাল চুরি করে পালাচ্ছিল। টিকিটও ছিল না। পরে শোনা গেছে সে কোনও ডাকাতের দলেও ছিল।”
“অতি সত্যি কথা। এখন প্রশ্ন হল, লোকটা কোথায়?”
“লোকটা পালিয়েছে। যতদূর মনে হয় মনসাপোঁতার জঙ্গলে গিয়ে ঢুকেছে। তবে ভাববেন না, মনসাপোঁতায় একবার ঢুকলে
কারও নিস্তার নেই। ভয়ঙ্কর জায়গা।”
লোকটা বলল, “যত ভয়ঙ্কর জায়গাই হোক, লোকটাকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। মনসাপোঁতা কোনদিকে?”
“সে অনেকটা দূর। রাতে সেখানে যেতে পারবেন না।”
“আমরা সকালেই রওনা হব। আজ রাতটা আমরা এই স্টেশনঘরেই কাটাতে চাই। আশা করি আপনার আপত্তি হবে না।” সতীশ মাথা নেড়ে বলল, “না, আপত্তি কিসের? কিছু রুটি-তরকারি পাঠিয়ে দেবখন।”
“তা হলে তো চমৎকার।” এই বলে লোকটা হাত বাড়িয়ে সতীশের হাত ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধুত্ব প্রকাশ করে বলল, “আমার নাম তিন সেন। আর এরা হল পচা, ল্যাংড়া আর সন্তু।”
হাতখানায় ঝাঁকুনি খেয়েই সতীশ বুঝে গিয়েছিল, তিনু সেন খুব শক্ত ধাতের লোক। সতীশের হাতটা যে ছিঁড়ে গেল না। সেটাই ভাগ্যের কথা। গোয়েন্দা-পুলিশ হলেও লোকগুলোর হাবভাব তেমন সুবিধের ঠেকছিল না তার। চোখগুলো যেন বড্ড জ্বলজ্বল করছে।
সতীশ টেবিলের কাগজপত্র একটু তাড়াহুড়ো করে গুছিয়ে রেখে বলল, “তা হলে আমি এখন আসি? পোটার লাখন একটু বাদে আপনাদের খাবার দিয়ে যাবেন!”
তিনু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এখানে থানা-টানা আছে?”
“আছে। কেন, সেখানে খবর পাঠাতে হবে? কাল সকালেই লাখনকে পাঠিয়ে দিতে পারি দারোগাবাবুর কাছে।”
তিনু মাথা নেড়ে বলে, “তার দরকার নেই। প্রয়োজন হলে আমরাই যাব। আপাতত আমরা লোকাল পুলিশের সঙ্গে ইনভড হতে চাই না।”
“ঠিক আছে।” বলে সতীশ তাড়াতাড়ি কোয়াটারে ফিরে এল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এই চারজন গোয়েন্দা-পুলিশের কথা সুদর্শন দারোগাকে জানানো দরকার।
রাত্রিবেলা লাখন রুটি-তরকারি পৌঁছে দিতে গিয়ে খুব গণ্ডগোলে পড়ে গেল। স্টেশনের ঘরে চারটে তাগড়াই লোক কেরোসিনের বাতির আলোয় জাম্বুবানের মতো বসে আছে। একজন নিবিষ্ট মনে টেবিলের ওপর চারটে পিস্তল পর পর সাজিয়ে রেখে সযত্নে গুলি ভরছে। অন্য একজন বেশ তেজী গলায় বলছে, “অভয় সরকার মাস্ট বি কিল্ড। কোনওভাবে যেন পুলিশ ওর নাগাল না পায়। তার জন্য দরকার হলে আরও দু-চারটে লাশ ফেলে দিতে হবে। যদি কেউ ওকে প্রোটেক্ট করতে চায়।”
লাখন ইংরেজি এবং বাংলা দুটোই কিছু-কিছু বোঝে। পিস্তল দেখে এবং কথাবার্তা শুনে কুস্তিগির লাখনেরও হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল।
যে-লোকটা কথা বলছিল সে লাখনকে হঠাৎ দরজায় উদয় হতে দেখে কথা থামিয়ে বাজখাই গলায় বলে উঠল, “তুই কে রে?”
পিস্তলওলা লোকটা ধাঁ করে একটা পিস্তল তুলে তাক করে বলল, “হ্যান্ডস্ আপ।”
লাখন কথাটা বুঝল, তবে হাত তোলার উপায় ছিল না। এক হাতে টিফিনবাটিতে রুটি, অন্য হাতে অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে তার তৈরি বিখ্যাত আলুর তরকারি। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি লাখন আছি বাবুজি। পোটার লাখন। আপলোগা খানা লায়া।”
“অ!” বলে প্রথম লোকটা যেন খুব তাচ্ছিল্য করে বলল, “ওই টেবিলে রেখে যা, আর শোন, খবরদার সাড়াশব্দ না করে এ-ঘরে কখনও আসবি না। একেবারে জানে মেরে দেব।”
লাখন এত কাঁপছিল যে, হাত থেকে বাটিটাটি পড়েই যেত। কোনওরকমে টেবিলে নামিয়ে রেখে সে প্রাণভয়ে পালাতে যাচ্ছিল, কিন্তু পিস্তলওলা লোকটা উঠে এসে প্ল্যাটফর্মে তার পথ আটকাল, “এই, তুই আমাদের কথা কিছু শুনতে পেয়েছিস?”
“নেহি বাবু, রাম কি কিরিয়া।”
“যদি শুনে থাকিস তো ভুলে যা। মুখ দিয়ে যদি টু শব্দটি বেলোয় তা হলে কিন্তু খুন হয়ে যাবি। মনে থাকবে?”
“জি বাবু।”
“এখানকার থানাটা কোথায়!”
“আধা মিল দুর হোবে। দুই দিকে।”
“দারোগা কেমন লোক?”
“ভাল লোক আছে বাবুজি।”
“ভাল মানে কি? চালাক-চতুর, না বুদ্ধ?”
কোনটা বলা ঠিক হবে, তা বুঝতে না পেরে লাখন একটু মাথা চুলকোল। তার মনে হল দারোগাবাবু বোকা হলেই এদের সুবিধে। সে বলল, “বড়বাবু বুন্ধু আছে।”
“আর তুই! তুই চালাক, না বুদু?”
“আমি-ভি বুদ্ধ আছে।”
“তোর চেহারাটা ভাল। কুস্তিটুস্তি করিস নাকি?”
“থোড়া থোড়া।”
“ঠিক আছে, আমাদের কাজটা মিটে যাক, তারপর তোর সঙ্গে একদিন কুস্তি হয়ে যাবে।”
লাখন ভয় পেয়ে বলল, “নেহি হুজুর, হামি তো হারিয়ে যাব।”
লোকটা হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, “লড়ার আগেই হেরে বসে আছিস! ঠিক আছে, তা হলে তোকে কুস্তির কয়েকটা প্যাঁচ শিখিয়ে দিয়ে যাব।”
“জি হুজুর মেবোন।”
“আর শোন, ওই স্টেশন-মাস্টারটা কেমন লোক?”