দুজনে বিদেয় হলে সুদর্শনবাবু উঠে তাঁর পুলিশের পোশাক পরে নিলেন। তারপর কোমরে রিভলভার এঁটে থানায় রওনা দিলেন।
থানা থেকে গোটাচারেক সেপাই সঙ্গে নিয়ে সুদর্শনবাবু মনসাপোঁতার জঙ্গলের ধারে যখন এসে পৌঁছলেন তখন বেশ বেলা হয়েছে, রোদ চড়েছে এবং খিদেও পেয়েছে। খিদে পেলে সুদর্শনবাবুর মাথার ঠিক থাকে না।
জঙ্গলের দিকে মুখ করে মুখের দৃধারে হাত দিয়ে চোঙার মতো করে সুদর্শনবাবু একখানা পিলে চমকানো হাঁক দিলেন, “ওরে, জঙ্গলের মধ্যে কে আছিস? যদি প্রাণে বাঁচতে চাস তো বেরিয়ে আয়। নইলে রক্ষে থাকবে না কিন্তু?”
কেউ সাড়া দিল না।
সুদর্শনবাবুর গলা আরও চড়ল, “বলি শুনতে পাচ্ছিস? ধরা না দিলে কিন্তু আমি ফোর্স নিয়ে জঙ্গলে ঢুকব। খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু তখন! একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটবে। ভাল চাস তো লক্ষ্মী ছেলের মতো দুটো হাত গৌরাঙ্গের মতো ওপরপানে তুলে বেরিয়ে আয়।”
কেউ এল না। সুদর্শনবাবু এবার গলা আরও ওপরে তোলার চেষ্টা করলেন, “ভাবছিস জঙ্গলের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে থেকে বেঁচে যাবি? জানিস এ-জঙ্গলে জয়রাম বেহ্মদত্যি থাকে? জানিস বুনো কুকুরদের কথা? তা ছাড়া সাপ-খোপ আছে, বাঘ-সিংহও থাকতে পারে। বিপদে পড়লে কিন্তু জানি না বাপু। কাজ কি তোর অত বিপদ মাথায় করে জঙ্গলে থাকার? থানায় ভাল বিছানা আছে, গায়ের কম্বল পাবি, চারবেলা মিনি-মাগনা খাওয়া জঙ্গলের চেয়ে ঢের ভাল। বলছি গুটিগুটি বেরিয়ে আয়। মারধর করব না রে বাপ, আমরা সেরকম লোকই নই।”
কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না।
সোজা আঙুলে যে ঘি উঠবে না এটা বুঝতে সুদর্শনবাবু একটু ফাঁপরে পড়লেন। কারণ বাঁকা আঙুলে ঘি তোলা কঠিন ব্যাপার। মনসাপোঁতার জঙ্গলে কেউ ঢুকবে না। তবু তিনি সেপাইদের দিকে রক্তচক্ষুতে চেয়ে অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বললেন, “জঙ্গলে ঢুকতে হবে। লোকটা ভেতরেই আছে।”
চারজন সেপাই সঙ্গে সঙ্গে চার হাত পিছিয়ে গেল। রামরিখ সিং বলল, “হুজুর, চাকরি যায় সে ভি আচ্ছা। দেশে ফিরে গিয়ে মকাইকা খেতি করব। লেকিন মনসাপোঁতায় ঘুসব না।”
অন্য সেপাইদেরও প্রায় একই কথা। চাকরি গেলে তাদের একজন ভিক্ষে করতেও রাজি, আর-একজন পানের দোকান দিতে চাইল এবং চতুর্থজন সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখাল।
মনসাপোঁতার জঙ্গল সম্পর্কে মানুষের ভয় অকারণে নয়। রাত্রিবেলা এই জঙ্গলে ভুতুড়ে আলো দেখা যায়, শোনা যায় নানারকম ভুতুড়ে শব্দও। দিনের বেলা আগে কাঠ কুড়োতে বা গাছ থেকে বুনো ফলপাকুড় সংগ্রহ করতে অনেকে ঢুকত। ইদানীং আর কেউ যায় না। কারণ আজকাল জঙ্গলে ঢুকলেই পেছন থেকে কে যেন আক্রমণ করে। পাথরের টুকরো বা ডাণ্ডা দিয়ে মেরে অজ্ঞান করে দেয়। তারপর টেনে জঙ্গলের বাইরে ফেলে দিয়ে যায়। জঙ্গলের ধারে যে অশ্বথ গাছটা আছে তার তলায় জবাফুল, কড়ি, জীবজন্তুর মাথা, হাড়গোড় ইত্যাদিও প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়। এইসব কারণে মনসাপোঁতা এখন সকলের কাছেই নিষিদ্ধ জায়গা।
সুদর্শনবাবু তা ভালই জানেন। ঢুকতে হলে তাঁকে একাই ঢুকতে হবে। কিন্তু সেটা কেন যেন সাহসে কুলোচ্ছে না। তাঁর ইচ্ছে, সেপাইদের জঙ্গলে পাঠিয়ে তিনি বাইরে ওত পেতে
থাকবেন। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছে পূরণ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তা বলে পঞ্চাশ হাজার টাকার কথাই বা তিনি ভোলেন কী করে? বেজার মুখ করে তিনি সেপাইদের বললেন, “ঠিক আছে, প্রত্যেকে দশ-দশ টাকা করে পাবি।”
সেপাইদের পায়ে তবু যেন পাথর বাঁধা।
সুদর্শনবাবু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “আচ্ছা যা, পঞ্চাশ-পঞ্চাশ।”
রামরিখ হাতজোড় করে বলল, “রূপাইয়া দিয়ে কী হবে বড়বাবু? জান না বাঁচলে রূপাইয়া দিয়ে কৌন কাম হোবে?”
ঠিক এই সময়ে একটা মস্ত পাথর জঙ্গলের ভেতর থেকে প্রচণ্ড জোরে এসে অশ্বথ গাছটার গায়ে লাগল। সবাই আঁতকে উঠল এই আচমকা ঘটনায়। কিন্তু তারপরই একের পর এক পাথর উড়ে আসতে লাগল।
“বাপরে!” বলে সেপাইরা উলটোদিকে দৌড় দিল।
সুদর্শনবাবু রিভলভার বের করে শূন্যে একবার ফায়ার করে বললেন, “সাবধান বলছি! খবরদার, ঢিল ছুঁড়বি না, গুলি করব।”
জঙ্গলের মধ্যে কে যেন হিঃ হিঃ করে রক্তজল করা হাসি হেসে উঠল।
সুদর্শনবাবু আর দাঁড়ালেন না। সেপাইদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তিনিও ছুটতে লাগলেন।
সন্ধেবেলার আপ ট্রেন থেকে চক্ৰপুর রেল স্টেশনে চারটে লোক নামল। চারজনের চেহারাই বেশ লম্বা-চওড়া মজবুত। সঙ্গে মালপত্র বিশেষ নেই, শুধু একটা করে সুটকেস।
চক্ৰপুরে এরা যে নতুন তা বুঝতে পেরে ট্রেনটা পাস করিয়ে সতীশ এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনারা কোথা থেকে আসছেন?”
চারজনের একজন অন্য সকলের চেয়ে একটু বেশি লম্বা এবং চওড়াও। লোকটা সতীশের দিকে চেয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বলে, “আমরা একটা তদন্তে এসেছি।”
“তদন্তে? আপনারা কি পুলিশের লোক?”
“হ্যাঁ। আমরা গোয়েন্দা।”
সতীশ সরকারি কর্মচারী এবং পুলিশ-মিলিটারি দেখলে খুবই শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ে। খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আসুন, আসুন, স্টেশনঘরে একটু বসুন। চক্রপুরে হঠাৎ গোয়েন্দা-পুলিশের আগমন হল কেন সেটা একটু শুনি।”
এ-প্রস্তাবে লোকগুলোর তেমন আপত্তি হল না। স্টেশনের
ছোট ঘরে এসে চারজন যখন কাঠের বেঞ্চটায় বসল তখন কেরোসিনের আলোয় চারজনের চেহারা একটু পরিষ্কার দেখতে পেল সতীশ! সত্যি কথা বলতে কি, চারজনের চেহারাই একটু যেন অস্বস্তিকর। একজনের কপালে একটা বেশ গভীর কাটা দাগ আছে। একজনের নাক ভাঙা। তৃতীয়জনের একটা চোখ কানা। চতুর্থজনের বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা নেই।