“নাঃ, প্রাণটা দেখছি বেঘোরেই যাবে!” বলে লোকটা শ্রান্ত শরীরে হেদিয়ে বসে রইল। “সত্য জয়তে” কথাটার মানেই হয় না। সত্যি কথা বলার গুনাগার যা দিতে হচ্ছে তা কহতব্য নয়।
বসে থাকতে-থাকতে লোকটার চোখ ঘুমে ঢুলে আসতে লাগল। সারারাত উদ্বেগ-অশান্তিতে তার ঘুম হয়নি। তার ওপর সকাল থেকে বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে। চারদিকে বিপদ জেনেও লোকটা ঢুলতে-দুলতে গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম যখন ভাঙল তখন দুপুর। বেশ চনচনে খিদে পেয়েছে। প্রচণ্ড জলতেষ্টা। জঙ্গলের মধ্যে রোদের চিকডিমিকড়ি এসে পড়েছে। ঝিঝি ডাকছে।
লোকটা চারদিকে চেয়ে ফের নিজের অবস্থাটা বিচার করে দেখল। খুবই খারাপ অবস্থা। নোংরা জামাকাপড় বদলানোর উপায় নেই। খাদ্য পানীয় নেই। বিছানা নেই। জঙ্গলের বাইরে অনেক শক্ত। জঙ্গলের মধ্যেও বন্ধু কেউ নেই।
তবে একটা ভাল ব্যাপার। লোকটার হঠাৎ নিজের নামটা মনে পড়ে গেল। লোকটার নাম অভয় সরকার।
২. চক্রপুরের দারোগাবাবু
চক্রপুরের দারোগাবাবুকে দেখলে যে কারও শ্রদ্ধা হবে। যাঁ, শ্রদ্ধা করার মতোই চেহারা। যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া এবং তেমনই দশাসই। যখন শ্বাস ফেলেন তখন মোষও লজ্জা পায়। ইদানীং ভুড়িটা বড্ড ঝুলে পড়েছে আর গলার নীচেও থাক-থাক চর্বি জমেছে বটে, কিন্তু এখনও একটু কষ্ট করলে ছোটখাটো একখানা খাসি বা মাঝারি একখানা পাঁঠার মাংস একাই সাবাড় করতে পারেন। অবশ্য তার সঙ্গে লুচি বা পরোটা থাকা চাই। শেষ পাতে একটু ক্ষীর দুবেলাই চাই। দিনের বেলা চারটি ভাতই খান বটে, তবে চার হাতা ভাত হলে দু হাতা ঘি লাগে। তা এ-সবের জন্য তাঁকে তেমন ভাবতে হয় না। দারোগাবাবু টিকে আছেন বলে গোটা এলাকাই টিকে আছে। লোকে তাই কৃতজ্ঞতাবশে এ-সবই জোগান দেয়। দারোগাবাবু খাবেন, এর চেয়ে আহ্লাদের ব্যাপার আর কী আছে?
আজ সকালবেলাতেই নেতাই আর জগা এসে হাজির। দুজনেই একসঙ্গে হাতজোড় করে বলল, “বড়বাবু, সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড। কুঞ্জখুড়োর বাড়িতে যারা ডাকাতি করেছিল তাদেরই একজন মনসাপোঁতার জঙ্গলে সেঁধোলো। অবশ্য এমনি সেঁধোয়নি, এমন তাড়া করেছিলাম যে, বাছাধন আর পালানোর পথ পায়নি।”
দারোগাবাবু, অর্থাৎ সুদর্শন হালদার গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে কোয়াটারের বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসে
ছিলেন। কথাটা শুনে কোনও ভাবান্তর হল না। শুধু বললেন, “আজ্ঞে আমরা হলুম তো মনসাপোঁতার জগা আর নেই। আমাদের কথাটা একটু মনে রাখবেন।”
সুদর্শনবাবু নিমীলিত নয়নে তাদের দিকে চেয়ে বললেন, “কেন, তোদের কথা আবার মনে রাখতে হবে কেন?”
নেতাই মাথা চুলকে একটু ফিচিক হাসি হেসে বলল, “কথাটা তা হলে খুলেই বলি বড়বাবু। কুঞ্জখুড়োকে তো চেনেন, সাতটা গাঁ মিলেও অতবড় বন্ধকি কারবার আর কারও নেই। সোনাদানা হীরে জহরত দাঁড়া দোনলা। ওঁর মক্কেলরা সবাই টাকার কুমির। ডাকাতরা এসে সেইসব গচ্ছিত জিনিস চেঁছেছে নিয়ে গেছে। কুঞ্জখুড়োর একটা মস্ত দোষ হল, সরকারবাহাদুরের ওপর একেবারেই ভরসা নেই। তাই ঠিক করেছেন ডাকাতদের হদিস যে দিতে পারবে তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রাইজ দেবেন।”
সুদর্শনবাবু সবেগে সোজা হয়ে বসে বললেন, “কত টাকা বললি?”
“আজ্ঞে পঞ্চাশ আছে আপাতত, তবে ওটা দু-একদিনের মধ্যেই লাখে উঠে যাবে মনে হয়।”
“কই, আমি তো প্রাইজের কথা শুনিনি!”
“আজ্ঞে ছোট মুখের কথা তো, এখনও বড় কান অবধি পৌঁছয়নি। তবে ভাববেন না, কুঞ্জখুড়ো গাঁময় ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। যে ধরবে সে পুলিশই হোক আর পাবলিকই হোক, পঞ্চাশ হাজার থোক পাবে। তাই বলছিলাম, আমাদের কথাটা একটু মনে রাখবেন। নিজের চোখে দেখা, ডাকাতটা মনসাপোঁতার জঙ্গলে ঢুকেছে।”
দারোগাবাবু একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, “কিন্তু সেই জঙ্গলটা তো ভাল নয় রে।”
নেতাই ঘাড় নেড়ে বলে, “আজ্ঞে না। ব্ৰহ্মদত্যির বাস তো আছেই, তার ওপর বুনো কুকুরেরও উৎপাত।”
“ডাকাতটার চেহারা কেমন?”
“আজ্ঞে ডাকাতের মতোই। মোটাসোটা, কালো, রক্তবর্ণ চোখ। ও ভুল হওয়ার জো নেই।”
সুদর্শনবাবু চিন্তিত মুখেই বললেন, “তোদের চক্রপুর তো ক্রমে-ক্রমে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে দেখছি। এই তো কিছুক্ষণ আগে স্টেশনমাস্টার সতীশ আর তার স্যাঙাৎ এসে নালিশ করে গেল, কে একটা লোক নাকি ট্রেন থেকে জিনিসপত্র চুরি করে নেমে পড়েছিল। রেল-পুলিশ বলেছে লোকটা স্টেশনের চৌহদ্দি পেরিয়ে যাওয়ায় তারা আর কিছু করতে পারবে না। এখন আমার যত দায়। আবার একটু আগে ফণিবাবুর নাতি পন্টু এসে বলে গেল, কে নাকি তাদের বাড়ি থেকে কদিন আগে কোদাল চুরি করে নিয়ে গেছে, আজ সকালে নাকি আবার আশ্রয় চুরি করতে এসেছিল। অবশ্য আশ্রয় কী জিনিস তা আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না। কিন্তু এ তো দেখছি চোর-ছ্যাঁচড়-ডাকাতদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠল!!”
নেতাই গদগদ হয়ে বলে, “সে সত্যি কথা, তবে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো আপনিও তো আছেন, আর সেইটেই আমাদের ভরসা। পঞ্চাশ হাজারের পঞ্চাশও যদি পাই তবে গোয়ালঘরটা ছাইতে পারি, একজোড়া লাঙলের ফালও কেনা বড় দরকার।”
সুদর্শনবাবু বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন, “এখন বাড়ি যা তো বাপু। আমাকে ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবতে দে।”