“বিপদে পড়লে লোকে কত কী বলে, ওসব বিশ্বাস করে আহাম্মকেরা। তোমাকে ঠিকই চিনেছি বাপু, চোখে কম দেখি বলে যে আমার চোখে ধুলো দিয়ে পালাবে তার জো নেই। পরশু কোদাল নিয়েছ, আজ আবার আশ্রয় না কী যেন নিতে এসেছ, তুমি তো মহা ধুরন্ধর হে! ওরে পন্টু, শুনছিস! বল্লমখানা নিয়ে আয়, এই কোদালচোর সাঙ্ঘাতিক লোক।”
ভেতর থেকে কে যেন হেঁড়ে গলায় বলে উঠল, “এই আসছি জ্যাঠামশাই, মুগুরটা আর দশবার ভেজেই আসছি। চোরটাকে ধরে রাখো।”
একথা শুনে লোকটা আর দাঁড়াল না। ফটক পেরিয়ে পাই-পাই করে ছুটতে লাগল। তবে তার কাছে ছোটাটা পাই-পাই মনে হলেও আসলে সে ছুটছিল নিতান্তই থপথপ করে, গজকচ্ছপের মতো। বুকে দম নেই, হাঁটু ভেঙে আসছে, তেষ্টায় কণ্ঠা অবধি শুকনো। তবে ভাগ্য ভাল, মুগুরভাঁজা শেষ করে পন্টু এখনও তার পিছু নেয়নি।
তবু সাবধানের মার নেই। লোকটা পথ ছেড়ে পাশের মাঠে নেমে পড়ল। সেখানে দিব্যি বুকমান উঁচু ধানগাছ। লুকনোর খুব সুবিধে। কোথায় যাবে তারই যখন ঠিক নেই, তখন ধানখেতে ঘুরে বেড়ালেই বা ক্ষতি কী?
এখন শরৎকাল। নীল আকাশে ভোরের সোনার রোদ ছড়িয়ে পড়েছে। মিঠে হাওয়া দিচ্ছে। পাখি ডাকছে। লোকটার বেশ ভাল লাগতে লাগল। গাঁয়ে-গঞ্জে বড় একটা যায়নি সে। প্রকৃতির শোভা যে এতদূর ভাল তা-ও যেন অজানা ছিল। আহা, কী সুন্দর!
ধানখেতের ভেতরে আলপথ বেয়ে লোকটা খানিকদূর এগোতেই দেখতে পেল দু-চারজন চাষি ধান কাটছে। কাছেই কোনও গ্রাম থেকে কুকুরের ঘেউ-ঘেউ আর গোরুর হাম্বা রব
ভেসে আসছে। লোকটার মন খুব ভাল হয়ে গেল। গাঁয়ের লোক নিশ্চয়ই খারাপ হবে না। গাঁয়ে যারা থাকে তারা হল গে সহজসরল মাটির মানুষ, সাত চড়ে রা কাড়ে না। সেখানে “গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।”
তবে সামনে যে ক’জন চাষিকে দেখা যাচ্ছে তারা কেউ গান গাইছিল না। একদম সামনেই যে চাষিটিকে দেখা যাচ্ছিল, তার মুখোনা ভারী তিরিক্ষে। তা হোক, এরা লোক খারাপ হয় না।
লোকটা যথাসাধ্য হাসি-হাসি মুখ করে এগিয়ে গিয়ে বলল, “এই যে ভাই!”
লোকটা ধান কাটতে কাটতে গোমড়া মুখটা তুলে গুরুগম্ভীর গলায় বলে, “কী চাই?”
বলার ধরনটা ভাল ঠেকল না, লোকটা একটু দমে গিয়ে বলে, “আচ্ছা, এদিকে ভাল লোক কি দু-একজনকে পাওয়া যাবে? বেশ নরম দয়ালু মন, অন্যের দুঃখে প্রাণ কাঁদে, দান করার ঝোঁক আছে, অথচ গায়ের জোর-টোর তেমন নেই পাওয়া যায় এমন মানুষ?”
চাষিটি কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে থেকে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে পাশের খেতের লোকটাকে হাঁক মারল, “ওরে নেতাই, এই সেই লোক।”
নেতাই চেঁচিয়ে বলল, “কে তোক রে?”
“আরে, গেল বুধবার কুঞ্জখুড়োর বাড়িতে যে ডাকাতি হল মনে নেই? সেই দলে ছিল। মুখে ভূসোকালি মাখা ছিল, তবু ঠিক চিনেছি। এ সেই দলের লোক।”
লোকটা হাঁ-হাঁ করে উঠল, “না, না, কোথাও খুব ভুল হচ্ছে খুব ভুল করছেন আপনারা ততক্ষণে দুই চাষি কাস্তে হাতে তেড়ে এল। লোকটা ফের পাঁই-পাঁই করে ছুটতে লাগল। সে যা ছুট তাতে যে-কেউ একটু পা চালিয়ে হেঁটেই ধরে ফেলতে পারত তাকে। কিন্তু কপালটা ভালই, মাঝখানে একটা জলের নালা থাকায় তোক দুটো চট করে কাছে চলে আসতে পারল না। নালাটা পেরোতে একটু ঘুরপথে আসতে হল। ততক্ষণে লোকটা ধানখেত পার হয়ে একটা জঙ্গলের ধারে পৌঁছে গেছে।
জঙ্গলে সাপ আছে কি বাঘ আছে সে বিচার করার সময় নেই। লোকটা হাঁফাতে-হাঁফাতে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বেশ নিবিড় অন্ধকার জঙ্গল। ঘন গাছপালা, লতা, ঝোঁপ সব রয়েছে। গা-ঢাকা দেওয়ার পক্ষে চমকার। লোকটা জঙ্গলে ঢুকে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাতে-হাঁফাতে কোমরে হাত দিয়ে একটু দাঁড়িয়ে রইল। আর চলবার ক্ষমতা নেই।
জঙ্গলের বাইরে সেই হেঁড়ে গলাটা শোনা গেল, “ওরে নেতাই, ডাকাতটা যে মনসাপোঁতার জঙ্গলে ঢুকে গেল!”
নেতাই খুব আহ্লাদের গলায় বলে, “ভালই হয়েছে রে জগা। ডাকাত ধরলে আমাদেরই ভয় ছিল। ওর দল এসে আমাদের কেটে ফেলত। তার চেয়ে মনসাপোঁতার ব্ৰহ্মদত্যিই নিকেশ করবে ওকে। ই- বাছাধন, এবার যাবে কোথায়?”
জগাও বেশ প্রফুল্ল গলায় বলল, “আর ব্রহ্মদত্যিই বা একা। কেন? শুখানালার বুনন কুকুরগুলোও রয়েছে। দেখতে পেলেই ছিঁড়ে খাবে।”
এইসব বলাবলি করতে করতে দুজনে চলে গেল।
লোকটা সভয়ে নিজের চারদিকটা দেখল ভাল করে। বিশাল বড় বড় গাছ চারদিকে। শাল-সেগুনই হবে। আর তার ফাঁকেফাঁকে ঝোঁপঝাড় আর লতাপাতায় চারদিকটা দুর্ভেদ্য হয়ে আছে।
লোকটা একটা বড় গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে ধুতির খুঁটে মুখের ঘাম মুছল। তারপর নিজের বর্তমান অবস্থাটা গম্ভীর মুখে বিচার করতে লাগল। যা অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে এ-জঙ্গল থেকে চট করে বেরনো ঠিক হবে না। অথচ খিদে-তেষ্টা আছে, ঘুম আছে, স্নানটান করাও আছে, এ-জঙ্গলে কীভাবে সেসবের
ব্যবস্থা হবে সেটাও চিন্তার বিষয়। তার ওপর ব্রহ্মদৈত্য এবং বুনন কুকুরের কথাও শোনা গেল। গতিক মোটেই সুবিধের ঠেকছে না তার কাছে।
হাত চার-পাঁচ দূরে শুকনো পাতায় একটা সরসর শব্দ হল। লোকটা সেদিকে তাকিয়ে যা দেখল তাতে শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। একটা হাত-তিনেক লম্বা গোখরো সাপ হিলহিল করে একটা গর্তে ঢুকে যাচ্ছে। ওপরেও একটা শব্দ হল। লোকটা তাকিয়ে দেখে, একটা মস্ত বানর ডালে বসে সবেগে পেট চুলকোচ্ছে।