লোকটা সভয়ে মাথা নেড়ে বলল, “সে বুঝেছি। তেজস্বী লোকদের জন্যই আজ আমার এই বিপদ। ওই যে গান্ধীজি– উনিও এক তেজস্বী লোক। তাঁর ফেরে পড়েই আজ আমার এই দুর্গতি। দুটো মিথ্যে কথা কইলে আজ কত সুখে থাকতে পারতুম। তা মশাই, আমি এখন একটু বাথরুমে যাব কি?”
সতীশ বলল, “সে যান। কিন্তু পালানোর চেষ্টা করবেন না। লাখন মস্ত কুস্তিগির, সে আপনার ওপর নজর রাখবে। আর পালালেও বিশেষ সুবিধে হবে না। এখানে নানারকম বিপদ। আপনার নামটি কী বলুন তো, নোট করে রাখি।”
“নাম!” বলে লোকটা ঢোক গিলল, “এই রে! নামটা যে ভুলে মেরে দিয়েছি।”
সতীশ চোখ কপালে তুলে বলে, “নিজের নাম ভুলে গেছেন! আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক মশাই।”
লোকটা সিলিঙের দিকে তাকিয়ে গলা চুলকোতে-চুলকোতে অত্যন্ত ব্যস্তভাবে ভাবতে লাগল। ঘন-ঘন মাথা নাড়ল। তারপর চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “পেটে আসছে, মুখে আসছে না। এত বিপদে কি মাথার ঠিক থাকে। মাথাটা কেমন যেন ফরসা হয়ে গেছে, একেবারে সাদা। তবে নিজের নামটা ভুরভুরি কাটছে ঠিকই। একটু সময় দিন, ঠিক মনে পড়ে যাবে।”
সতীশ মাথা নেড়ে বলে, “ওসব চালাকি আমার ঢের জানা আছে। যে নিজের নাম চাপা দিতে চায় তার ভালরকম গলদ আছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে আপনি কোনও গুরুতর রকমের অপরাধ করে পালিয়ে এসেছেন। হয়তো খুন, হয়তো ডাকাতি। নাঃ, আর দেরি করা ঠিক হবে না। রেল-পুলিশে খবরটা তো আগে দিই, তারপর এখানকার থানাতেও ব্যাপারটা জানাতে হবে।”
একথায় লোকটা খুব অবাক হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল, মুখে বাক্য সরল না। শুধু বারকয়েক শুকনো মুখে ঢোক গিলল। মুখোনা এমন করুণ আর ফ্যাকাসে হয়ে গেল যে, সতীশের মতো দৃঢ়চেতা লোক না হয়ে অন্য কেউ হলে সেই করুণ মুখ দেখে হয়ত করুণায় কেঁদেই ফেলত। কিন্তু সতীশ বজ্রকঠিন মানুষ। অন্যায় সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তার সঙ্গী খনও তার মতোই। লাখন কুস্তিগির পালোয়ান এবং পরম রামভক্ত মানুষ। রোজ সে রামচরিতমানস সুর করে পড়ে, রাম-সীতা এবং বজরঙ্গবলীর পুজো না করে জলগ্রহণ করে না। সে-ও অন্যায়-অধর্ম সইতে পারে না। সুতরাং লোকটার মুখ দেখে কারও তেমন করুণার উদ্রেক হল না।
লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাঙা গলায় বলল, “এরেই কয় মাইনকা চিপি।”
সতীশ গলা চড়িয়ে বলল, “কী বললেন? গালমন্দ করছেন নাকি?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে না। গালমন্দ নয়। কথাটা আমার দাদু প্রায়ই বলতেন।”
“কথাটার মানে কী?”
“আজ্ঞে সেটা আমিও ঠিক জানি না। শুধু জানি মাইনকা চিপি।”
“এটা কি বাঙল ভাষা?”
“তা হতে পারে।” বলে লোকটা চোখ বুজে বড়বড় খাস ফেলতে লাগল। দীর্ঘশ্বাসই।
সতীশ বেরিয়ে গেলে লোকটা করুণ নয়নে লাখনের দিকে চেয়ে বলে, “লাখনদাদা, আমি একটু বাথরুমের দিকে যেতে পারি?”
“হাঁ, হাঁ, কিউ নেহি? লেখিন ভাগবার কোসিস করবেন না। খবরদার। পুলিশ আসবে, বিচার হোবে, তারপর রামজীর যো হিচ্ছা সো হোবে।”
লোকটা বিগলিত হয়ে মাথা নেড়ে উঠে পড়ল। রেলের কোয়াটারের ভেতরদিকে একটা উঠোন। উঠোনের এককোণে স্নানঘর। উঠোনটা বেশ উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। তবে পেছনদিকে জমাদার আসবার একটা দরজা আছে। সেটাতে হুড়কো দেওয়া। লোকটা স্নানঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর দরজার পাল্লা সামান্য ফাঁক রেখে নজর করে দেখল, লাখন দরজায় দাঁড়িয়ে একবার হাই তুলল, তারপর আড়মোড়া ভেঙে “জয় বজরঙ্গবলী” বলে দু-চারবার ডন-বৈঠক করে নিল। এ সময়ে বাইরে থেকে হঠাৎ হেঁড়ে গলায় কে হাঁক দিল, “এ লাখনভাই, তোর ভৈস কাঁহ ভাগলবা? খোটুয়া উখাড়কে ভাগলবা রে।”
“আয়া রে।” বলে লাখন এক দৌড় মারল।
লোকটা আর দাঁড়াল না। পেছনের দরজার হুড়কো খুলে বেরিয়ে প্রাণপণে দৌড়তে লাগল। কিন্তু মুশকিল হল, লোকটা জীবনে দৌড়ঝাঁপ করেনি, শরীরটাও থলথলে। ফলে দৌড়লেও কোনও লাভ হচ্ছিল না। উপরন্তু লোকটা একটা ছোটখাটো মাঠ পেরোতে গিয়েই ঘেমে, হাঁফিয়ে বেদম হয়ে পড়ল। সারা শরীর ঝনঝন করতে লাগল দৌড়ের ধাক্কায়।
মাঠ পেরিয়েই একটা বাগানওলা পাকাবাড়ি দেখে লোকটা সটান ঢুকে পড়ল। বারান্দায় বসে এক পাকাচুলের বুড়ো মানুষ হুঁকো খাচ্ছেন। লোকটাকে দেখে তিনি হঠাৎ আঁতকে উঠে চেঁচাতে লাগলেন, “ও বাবা, এ যে মস্ত এক কেলে গোর ঢুকে পড়েছে বাগানে! ওরে পন্টু, তাড়া শিগগির গোরুটাকে, সব গাছ খেয়ে ফেলবে?”
লোকটা আতঙ্কিত হয়ে হাতজোড় করে বলে, “আজ্ঞে আমি গোরু নই। বড় বিপদে পড়ে এসেছি, যদি একটু আশ্রয় দেন।”
বৃদ্ধ কোটি রেখে ভ্রূ কুঁচকে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “অ, তা ভাল কথা। কিন্তু বাপু, আমার কোদালখানা কি করলে?”
লোকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলে, “কোদাল! কোদালের কথা উঠছে কেন?”
বুড়ো খ্যাঁক করে উঠলেন, “কোদালের কথা কি আর এমনি ওঠে বাপু! ন্যাকামি কোরো না। পরশুদিন এসে সক্কালবেলায় তুমি আমার কোদালখানা চালাকি করে নিয়ে যাওনি? খুব তো ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছিলে, জ্যাঠামশাই, আমি হরি সামন্ত, কোদালখানা একটু দেবেন, ও-বেলা দিয়ে যাব। তা আমিও হরি সামন্ত মনে করে কোদালখানা দিয়ে দিলুম। পরে হরি এসে বলল, সে পরশুদিন এখানে ছিলই না।”
লোকটা হাতজোড় করেই বলল, “আজ্ঞে আমিও ছিলুম না। আজ সকালেই আমার এখানে প্রথম আগমন হল।”