সেপাই মগন বলল, “দো মাহিনাকা তলব আর জান ভি।”
কিচলু বলল, “হাঁ হাঁ জরুর, কিউ নেহি। জান লিবেন সো তো আচ্ছা বাত। আউর হামার তিন মাহিনাকা তনখা আর দোটো ভৈঁস ভি দিয়ে দিব মালিক।”
রামু বলল, “আজ্ঞে, আমার ছেলেবেলা থেকেই ক্ষুদিরামের মতো দেশের জন্য ফাঁসিতে ঝোলার বড় শখ। তা হুজুরের দয়ায় সেরকমটা হলে বড় ভাল হয়। আর ফাঁসিতে যেতে-যেতে ওই গানটাও কিন্তু আমাকে গাইতে দিতে হবে, হাসি হাসি পরবো ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী…”।
লালারাম বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল, “হজৌর, জান কখুন দিতে হোবে? জারা আগারি বললে থোড়া বহুত রোটি আর মূলি কি সজী খায়ে লিব। আউর এক লোটা দুধ।”
মগন বলল, “হমি জারা রামজিকি ভজন ভি কোরে লিব। আউর এক দফে পূজা চড়িয়ে দিব বজরঙ্গবলী কি মন্দিরমে।”
কিচলু মাথা চুলকে বলে, “এক দফে হরদোয়ার ঘুমে আসলে দেশকা লিয়ে জান দেনে সে কোই হরজা নেহি।”
রামু বলল, “আমার ওসব নয় বাবা। কলকাতার রায়ট রেস্টুরেন্টের কবিরাজি কাটলেট আর মোগলাই পরোটা একবারটি খেয়ে নিলেই হবে। আর একটা হিন্দি সিনেমা।”
সুদর্শনবাবু রুমালে কপাল মুছতে মুছতে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে খানিকক্ষণ পায়চারি করে বললেন, “ওসব মতলব ছাড়ো। দেশ তোমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করতে ডাকছে। এখনই,
এই মুহূর্তে। আর সময় নেই। একটু আগে শুনলে তো, চোঙা ফুকে কী বলে গেল!”
লালারাম অবাক হয়ে বলে, “উতো কুঞ্জবাবুকা কোঠি মে ডাকাকা বাত। উনকো লুটা মাল আপস লানে পর কুছ মিলেগা!”
সুদর্শনবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, “কুছু নয় রে বাবা, কুছ নয়। কুছ বলে তুচ্ছ করিস না। দু লাখ! বুঝলি!দু লাখ!”
“হ হাঁ, দো-চার লাখ কোই বাত নেহি।”
সুদর্শনবাবু অবাক হয়ে বলেন, “বলিস কী? দু-চার লাখ কোনও কথাই নয়! দু লাখে কত হয় জানিস? দু’শো হাজার টাকা!”
“হবে মালিক। হামি গরিব আমি। দো-পাঁচ জানি, দো-চারশো জানি, লেকিন উসকা জেয়াদা কুছু জানি না।”
রামু বিরক্ত হয়ে বলে, “কিন্তু কী করতে হবে সেটাই তো বুঝতে পারছি না বড়বাবু।”
“বলছি, বলছি। ডাকাতরা শুখানালার সরকারদের পোড় বাড়িতে সব মাল মজুদ করেছে। মালটা আমাদের উদ্ধার করতে হবে।”
শুখানালার নাম শুনেই চারজন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। লালারাম বলল, “উ হোবে না মালিক।”
একগাল হেসে সুদর্শনবাবু বললেন, “শোন রে শোন, আমি ঠিক করেছি তোদের চারজনকে পাঁচ… না, পাঁচ কেন, দশ-দশ হাজার করেই দেব। বাকি লাখ-দেড়েক আমার থাকবে।”
“উ হোবে না মালিক।” রামু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “মোটে দশ হাজার! ধুস!”
সুদর্শনবাবু বললেন, “আচ্ছা, না হয় আরও হাজার টাকা ১০০ দিলুম।”
রামু মাথা নাড়ল, “পোষাচ্ছে না সার।”
বেশ কিছুক্ষণ দরাদরির শেষে ঠিক হল, সেপাইরা পঁচিশ হাজার করে পাবে। সুদর্শনবাবু পুরো এক লাখ। স্টেশনের লাখন, গাঁয়ের নেতাই, রেমো, আর অক্ষয়কে নিতে হবে। তারা শুখানালা যাওয়ার একটা শর্টকাট চেনে। তবে ওদের কোনও ভাগ দেওয়া হবে না। পঞ্চাশটা করে টাকা ফেলে দেওয়া হবে শুধু। কাল শেষ রাতেই রওনা দিতে হবে।
তূপের ওপর সারারাত লাঠি হাতে বসে রইল অভয়। বসে বসেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। ঘুম যখন ভাঙল তখন চারদিকে যেন স্বর্গের ছবি। কুয়াশামাখা আকাশে দিপ-দিপ করছে নিবন্ত সব তারা। পাখি ডাকছে। আর শরীরে যেন আনন্দের ঢল নেমে এসেছে অভয়ের। মনটা হালকা, শরীরটাও ভারী ফুরফুরে। সে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখল। এখনও ফরসা হয়নি বটে, কিন্তু শেষ রাতের মরা-জ্যোৎস্নায় অনেকটা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এবাড়িতে ছিল বিশাল বাগান, পুকুর, আস্তাবল, গোয়াল, ছিল নহবতখানাওয়ালা ফটক, কাছারি। কালের অমোঘ নিয়মে সব মাটিতে মিশে গেছে। তবু এই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তার খুব চেঁচাতে ইচ্ছে করল আনন্দে। তাই সে চেঁচাল, “এই হচ্ছে আমার বাড়ি! আমার বাড়ি!”
সেই শুনে যেন একটা পাথরের পরি তার শেষ ঠেকনোটা ভেঙে হঠাৎ গড়িয়ে পড়ল। দু-আধখানা হয়ে গেল ভেঙে।
“আহা রে।” বলে এগিয়ে গিয়ে অভয় পরিটাকে তুলতে গেল। এবং সবিস্ময়ে দেখল, পরির ফাঁপা পেটের ভেতরে একটা লোহার বাক্স। কাঁপা হাতে সে বাক্সটা তুলে নিয়ে খুলল। যা দেখল তা অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!
বাক্সটা বুকে ধরে চুপ করে বসে রইল অভয়। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠল। অভয় উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “আমি আবার সব গড়ে তুলব।”
নিজের গলার স্বর শুনে অভয় চমকাল না বটে, কিন্তু চারদিক চমকাল। অভয় নিজে বুঝতেও পারল না সে কতটা বদলে গেছে এক রাতে। সেই থলথলে, ভিতু, করুণার পাত্র অভয় আর নেই। বদলে দাঁড়িয়ে আছে এক শক্তিমান পুরুষ, অকুতোভয়। তার চোখে ঝলকাচ্ছে আত্মবিশ্বাস।
অভয় জানতেও পারল না, জঙ্গলের ভেতরে ঝোঁপঝাড় ভেঙে সুদর্শনবাবু আর তাঁর দলবল একটা বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। চারজনের হাতে রাইফেল, সুদর্শনবাবুর হাতে রিভলভার, নেতাই, অক্ষয় আর রেমোর হাতে পাকা বাঁশের লাঠি।
রেমো বলল, “হুজুর, এই হল সরকার বাড়ির চৌহদ্দি। আমাদের চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য ভাল যে, এই অবধি আসতে পেরেছি।”
একটু ধরা গলায় অক্ষয়ও বলল, “ভীম সরকারের এলাকায় কখন যে কী ঘটে যায় কিছু বলা যায় না।”