তিনু ঘড়ি দেখল এবং আকাশের দিকে চাইল। তারপর বলল, “আমরা খাতে না নেমে যদি ধার দিয়ে দিয়ে যাই তা হলে ওকে স্পট করতে সুবিধে হবে।”
কালু হঠাৎ গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “আমি আর যাব না। আপনারা খুনখারাপি করবেন, সেটা চোখে দেখা আমার সহ্য হবে না। শুখানালার সীমানা ডিঙোলেও আমাদের বিপদ আছে, সে আপনারা ভূতপ্রেত মানুন বা না-মানুন।”
তিন মোলায়েম স্বরে বলে, “আমরা পাঁচজন শক্তপোক্ত পুরুষ-মানুষ যদি ভয় খাই তবে অভয় সরকারের মতো ভেড়য়া শুখানালায় ঢুকল কী করে? তার ভয়ডর নেই? ওসব চালাকি ছাড়ো। গাঁয়ের লোকের অনেক কুসংস্কার থাকে। ওসব আমরা মানি না। আর খুনের কথা বলছ? অভয় সরকারকে যদি না পাই তা হলে তোমার নিজের দশা কী হবে জানো? যা বলেছি ঠিক তাই রব, দু-আধখানা করে কেটে ফেলে রেখে যাব জঙ্গলে। চলল!”
কালু তবু সভয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিনু তাকে দমাস করে এমন একখানা ঘুসি মারল মুখে যে, কালু ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। সামনের একটা দাঁত উপড়ে গিয়ে গলগল করে রক্তে ভেসে গেল তার মুখ।
“ওঠ শয়তান।” হুকুম দিল তিনু।
কালু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। হাতে তার নিজের ওপড়ানো দাঁতখানা রক্তে ডুবে আছে। চোখে জল এল কালুর। নীরবে সে মুখ ফিরিয়ে চলতে শুরু করল। পেছনে চার সশস্ত্র নিষ্ঠুর খুনি, তার পালানোর উপায় নেই।
তীক্ষ্ণ চোখে চারজন তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখছে শুখানালার খাত। অভ্যস্ত চোখে ধরা পড়ছে অভয় সরকারের গমনপথ। তারা বেশ দ্রুতই এগোতে লাগল। শিকার আর দূরে নেই।
হঠাৎ এক জায়গায় দেখা গেল, খাতের মধ্যে মথিত ঘাসের চিহ্ন শেষ হয়েছে। অর্থাৎ খাতের মধ্যে অভয় সরকার ওখানেই ঘাপটি মেরে আছে।
তিনু চাপা গলায় বলে, “এইবার! শয়তানটা ওখানেই নিশ্চয় নেতিয়ে পড়ে আছে। লেট আস ফিনিশ হিম।”
কালুকে পেছন থেকে একটা লাথি মারল তিনু। কালু লাথি খেয়ে গড়িয়ে খাতের মধ্যে পড়ে গেল। পেছনে চারজন নেমে এল বেড়ালের মতো তৎপর পায়ে। চপার দিয়ে চারদিককার আগাছা সাফ করে যখন তারা সন্দেহজনক জায়গাটায় এল তখন দেখা গেল, সেখানে অভয় সরকার নেই।
পচা হঠাৎ চাপা গলায় বলল, “ব্যাটা ওখান দিয়ে উঠে গেছে। ওই যে মাটির গায়ে দাগ।”
খাত থেকে অভয় যেখানে উঁচু পাড়ে উঠেছিল সে জায়গায় নরম মাটিতে তার হাঁচোড়-পাঁচোড়ের দাগ এখনও টাটকা। পাঁচজন জায়গাটা দেখছিল।
আচমকা দূরে এক জলকল্লোল শুনতে পেল পাঁচজনই। তিনু কালুর দিকে ফিরে বলল, “এখানে ঝরনা আছে কোথাও? শব্দ কিসের? এতক্ষণ তো শুনতে পাইনি!”
কালুর মুখ সাদা হয়ে গেছে ভয়ে। ঠোঁট কাঁপছে। সে মাথা নেড়ে জানাল, এখানে ঝরনা নেই।
তিনু জলের শব্দ যেদিক দিয়ে আসছে সেদিকে চেয়ে থেকে বলল, “এ তো দেখছি সাঙ্ঘাতিক স্রোতের শব্দ! নিশ্চয়ই পাহাড়ি নদীটদী আছে।”
কালু অস্ফুট গলায় বলল, “কাজটা আপনারা ভাল করেননি। এই এলাকা ভীম সরকারের। আমরা কেই ওকে চটাই না।”
“চোপ!” বলে তিনু একটা ধমক দিল। বস্তুত সে বুঝছিল না যে, জলের শব্দ শুনে কালুর এত ভয় পাওয়ার কী আছে। ঝরনা বা পাহাড়ি নদীর শব্দ তো এরকমই হয়!
পচা বলল, “অভয় তা হলে আরও কিছুটা এগিয়ে গেছে! তিনুদা, আজ আর আমাদের সন্ধের গাড়িটা ধরা হল না।
অলরেডি সন্ধে হয়ে এল। দেখেছ কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক।”
তিনু চিন্তিতভাবে ঘড়ি দেখে বলল, “দেখছি। কিন্তু আমার হিসেবমতো অন্ধকার হতে আরও আধঘণ্টা লাগা উচিত। এত তাড়াতাড়ি তো আলো মরে যাওয়ার কথা নয়!”
ল্যাংড়া বলে, “জঙ্গলে তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়, এ তো সবাই জানে।”
তিনু তবু চিন্তিতমুখে ভ্রূ কুঁচকে আকাশটা দেখল। আর আচমকাই সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “ও কী?”
প্রত্যেকেই চমকে সামনের দিকে ঘুরে তাকাল। দূরের জলকল্লোল কাছে চলে এসেছে এবং মেলট্রেনের মতোই ধেয়ে আসছে প্রলয়ঙ্কর জলরাশি। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে সফেন জলরাশির শীর্ষে ঢেউ যেন লক্ষ হাত তুলে প্রবল এক প্রতিবাদেই ধেয়ে আসছে।
তিনুকে এই প্রথম ভয় পেতে দেখা গেল, সে চেঁচিয়ে কালুকে ধমকাল, “এই বদমাশ! ওঠ ওপরে, আমাকে টেনে তোল।”
কালু তিলমাত্র দেরি না করে এক লাফে ওপরে উঠে গেল। তিনু আর তার তিন সঙ্গীও উঠে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু তাদের সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত করে দিয়ে উত্তাল জলরাশি কূল ছাপিয়ে ধেয়ে এল। তীর থেকে তাদের চারজনকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে তরঙ্গে-তরঙ্গে লোফালুফি করতে করতে নিয়ে চলে গেল!
কালুরও যাওয়ার কথা। কিন্তু ভাগ্য ভাল, কোমরের দড়ির প্রান্তটা তিনু ধরে রাখতে পারেনি।
কালু আর দাঁড়াল না। প্রাণপণে পিছু ফিরে ছুটতে লাগল। ছুটতে-ছুটতেই দেখতে পেল, শুখানালা খটখট করছে শুকনো। কোথাও জলের চিহ্নমাত্র নেই। শব্দ নেই। স্রোত নেই।
কুঞ্জগুড়ো পুরস্কারের পরিমাণ দৃ লাখ পর্যন্ত বাড়িয়ে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিলেন। ঢ্যাঁড়াওয়ালা যখন থানার সামনে দিয়ে ঢ্যাঁড়া বাজিয়ে চোঙা ঠুকে সুসংবাদটি প্রচার করে গেল তখন আর সুদর্শনবাবু থাকতে পারলেন না। মোট চারজন নির্ভরযোগ্য সেপাইকে ডেকে লাইন আপ করিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, “তোমরা কে কে দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত?”
সেপাই লালারাম এই কথায় বুক ফুলিয়ে বলল, “দেশের জন্য হুজুর, জান তো জান, এক মাহিনার তলব ভি দিয়ে দিব।”