অভয় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। পায়ে যেন পাথর বাঁধা, বুকটা ধকধক করছে। আর এগনো কি ঠিক হবে! তার মনে হচ্ছে সে যেন এক মহাভয়, মহাসর্বনাশ, মহাশোকের সমুদ্রের খুব কাছাকাছি এসে গেছে। ওই শোক-সমুদ্রের ঢেউই যেন অনাদিকালের বিরহ বুকে নিয়ে ক্রমান্বয়ে নিরবধি ডেকে চলেছে, “আয়… আয়… আয়.. আয়…”
অভয় হাতের লাঠিটা বড় জোরে চেপে ধরেছিল নিজের অজান্তেই। আঙুলগুলো টনটন করে ওঠায় তার খেয়াল হল। মুঠোটা একটু আলগা করল সে। শরীরটাও আড়ষ্ট, শক্ত হয়ে গিয়েছিল। শরীরও এবার সহজ হল। অভয় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুকভরে শ্বাস নিল। তারপর লাঠিটা মাটিতে কয়েকবার ঠুকে নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “কাউকে না, আমি কাউকে ভয় খাই না। আয় না ব্যাটা কে আসবি।” এই বলে সে এগোতে লাগল। বুক কাঁপছে, পা কাঁপছে। তবু অভয় থামল না।
টেনে-টেনে দীর্ঘ করুণ স্বরে কে যেন কাকে ডেকেই চলেছে, “আয়… আয়… আয় আয়।” বিরামহীন। বিরক্তিহীন।
অভয় হাঁটতে লাগল। হাঁটতেই লাগল। রাত গাঢ় হল। গাছে-গাছে পাখিদের ঝগড়া থেমে গেছে অনেকক্ষণ। চারদিক বড় নিঝুম। ঝিঝির ডাক, নিজের পায়ের শব্দ আর সামনে ওই ক্ষীণ “আয়… আয়…” ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
হঠাৎ বনে মর্মরধ্বনি তুলে এই শীতের কুয়াশামাখা রহস্যময় রাতে একটা দমকা বাতাস বয়ে গেল। শুকনো পাতা গড়িয়ে গেল বনময়। কোনও জঙ্গুলে ফুলের মোহময় গন্ধ ছড়াল হঠাৎ। আর তারপরেই অভয় একটা পেল্লায় হোঁচট খেয়ে পড়তে-পড়তে সামলে গেল।
অন্ধকারেও সে টের পেল, তার সামনে একটা বাধা।
হাতড়ে-হাতড়ে সে বুঝতে পারল, একটা পাথর বা সিমেন্টের থাম বা ওই জাতীয় কিছু। সেটা ডিঙিয়ে অভয় যেখানে পা দিল সেটা আগাছায় ভরা বটে, কিন্তু পায়ের তলায় ইট-সুরকি, পাথরের টুকরো, লোহার বিম, কাঠের বরগা ইত্যাদির একটা বিরাট ধ্বংসস্তূপ। টিলার মতো উঁচু সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে লাগল অভয়। এখন সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল, মাটির গভীর থেকে কে যেন ডাকছে, “আয়… আয়… আয়… আয়…”
অভয় ধীরে-ধীরে ধ্বংসস্তূপের ওপরে উঠে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সেই “আয় আয়…” শব্দটা স্তব্ধ হয়ে গেল। আর তারপরেই চারদিকে যেন মৃদু একটা ঘূর্ণিঝড় উঠল। তার সঙ্গে উঠল গাছে-গাছে মরধ্বনি। পাখিরা ঘুম ভেঙে ডেকে উঠল। তারপর সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পায়ের নীচে মাটিটা কি একটু দুলে উঠল? কে জানে! কিন্তু এটা স্পষ্ট টের পেল অভয়, ধ্বংসস্তূপে এতকাল যেন একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা ছিল। সে এসে দাঁড়ানোর পর হঠাৎ সেই চাপা দীর্ঘশ্বাসটা বহুঁকাল পরে মুক্তি পেয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।
অন্ধকারে চারদিকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবু অভয়ের স্পষ্ট মনে হল, এই তার পূর্বপুরুষের ভিটে। শুখানালার সরকারবাড়ি। মন্ত বাড়ি ছিল একসময়ে, পাইকবরকন্দাজ ছিল, মস্ত আস্তাবল ছিল, অনেক কিছু ছিল। সেই বাড়িতে বহুঁকাল পর একজন বংশধর ফিরে এসেছে। অভয় শীতে অন্ধকারে অনিশ্চিত অবস্থায় দাঁড়িয়েও আপনমনে একটু হাসল, তারপর মাটিতে লাঠিটা ঠুকে বলল, “এটা আমার বাড়ি। বুঝলে সবাই? এটা আমার বাড়ি।”
একথা শুনে একটা তক্ষক ডেকে উঠল, “ঠিক ঠিক।”
৬. ওই হচ্ছে শুখানালা
“ওই হচ্ছে শুখানালা! এবার আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর যাব না।”
তিনু ভ্রূ কুঁচকে বলে, “যাবে না মানে! আলবাত যাবে। শুখানালা-ফালা আমরা জানি না। আমরা অভয় সরকারকে চাই। যতক্ষণ তাকে পাওয়া না যাচ্ছে ততক্ষণ তুমি তার জামিন।”
কালু কাতর মুখে বলে, “শুখানালা ভীম সরকারের এলাকা। এখানে কেউ ঢোকে না। এখানে নানারকম ভুতুড়ে কাণ্ড হয়। আঁতুড়ে ছেলের কান্না শোনা যায়, নালায় জল আসে, আরও সব। আমাকে ছেড়ে দিন।”
তিনু তার চপারটার চওড়া দিক দিয়ে কালুর পিঠে সজোরে মেরে ভয়ঙ্কর গলায় বলল, “বেশি ট্যাঁ-ফোঁ করলে কিন্তু কেটে রেখে যাব!”
ট্যাঁ-ফোঁ করার অবস্থা অবশ্য কার নয়। তার কোমরে শক্ত করে দড়ি বাঁধা, সেই দড়ির প্রান্ত তিনুর বাঁ হাতে জড়ানোকালু যদি দড়ি ছিঁড়ে পালায়ও, তবে পেছনের তিনজনের তিনটে পিস্তল তাকে ঝাঁঝরা করে দেবে। তাই সে ভয়ে ঘামতে লাগল। কাতর স্বরে বলল, “আমাদের এ এলাকায় ঢোকা বারণ।”
তিনু বলল, “শোনো বুন্ধু, আমরা ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করি না। আমরা খুব প্র্যাকটিক্যাল লোক। যেমন-তেমন করে কাজ হাসিল করতেই আমরা ভালবাসি। ভূতপ্রেত যদি থেকেও থাকে তবে জেনো, তারাও আমাদের ভয় খায়।”
শুখানালার পাত দেখা গেল একটা বাঁশঝাড়ের পরেই। কালু দাঁড়িয়ে গেল, “ওই যে।”
“ওটাই শুখানালা! তা বেশ। অভয় সরকার ভিতু লোক, সে গা-ঢাকা দেওয়ার জন্য অবশ্যই খাতের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকবে। সন্তু, দেখ তো, খাতের ভেতর কোথাও ঘাসটাস
বে-গোছ হয়েছে কিনা।”
সন্তু অত্যন্ত অভ্যস্ত চোখে খাতের ধারে গিয়ে একটু দেখেই বলল, “এই তো এখানে ঘষটানোর দাগ রয়েছে। কুমড়োপটাশটা বোধ হয় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ তিনুদা, ওই যে ঘাসটাস লণ্ডভণ্ড করে জলহস্তীর মতো গেছে।”
তিনুর মুখে হাসি ফুটল, “তা হলে শিকার বেশিদূর যেতে পারেনি। ওই থলথলে শরীর নিয়ে আর কতদূরই বা যাবে।”
ল্যাংড়া বলল, “সে তো ঠিক কথা। কিন্তু এদিকে যে রোদ মরে আসছে তা দেখতে পাচ্ছ? অন্ধকার হয়ে গেলে কাজটা কঠিন হবে।”