মিনিট পাঁচেক পর শব্দটা বন্ধ হয়ে বনভূমি আবার নির্জন হয়ে গেল। ভয় পাবে কিনা তা বুঝতে পারছিল না অভয়। ভয় পাওয়াই বোধ হয় উচিত।
তবে কিনা দুদিন ধরে সে এত ভয়ের মধ্যে আছে যে, নতুন করে আরও ভয় পাওয়া একটু কঠিন। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের লাঠিটা কয়েকবার নীরবে আস্ফালন করে খাতের ধার ধরে ধরে হাঁটতে লাগল।
আচমকাই ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে ফের তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। কারা ওরকম হুঙ্কারে তেড়ে আসছে ঘোড়ায় চেপে? কয়েকশো ঘোড়ার ছুটন্ত খুরের আওয়াজ আর সেইসঙ্গে মানুষের রণং দেহি চিৎকার দূর থেকে ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে তারই দিকে। হাতের লাঠিটার দিকে কাতরভাবে একবার তাকাল অভয়। একটু আগেই সে “কে আসবি আয়” বলে খুব বীরত্ব দেখিয়েছিল। এখন সেটা বেবাক ভুলে গিয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইল বোকার মতো। কারা আসছে তা এখনও দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু এল বলে। অভয় লাঠি ফেলে সভয়ে পাশের একটা ঝুপসি গাছে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে পড়ল। জীবনে গাছে ওঠেনি সে, গাছ বাইতে জানেও না। কিন্তু প্রাণের দায়ে যতটা পারে ওপরদিকে উঠে একটা বেশ লতাপাতার আড়াল দেখে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসল। ওদিকে সৈন্য-সামন্তরা তেড়ে আসছে। ঘোড়ার ডাক, রণহুঙ্কার এবং অস্ত্রের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে ঘোড়ার পায়ের খটাখট শব্দ।
অভয় চোখ পলকহীন করে চেয়ে রইল নীচের দিকে। ঘোড়ার লেজটুকু বা মানুষের একটা মাথাও তার নজরে পড়ল না। অথচ বনভূমি প্রকম্পিত করে তার গাছের তলা দিয়ে এবং আশপাশ দিয়ে ওই ভয়ঙ্কর শব্দ বয়ে গেল খানিকক্ষণ ধরে। তারপর আবার সব চুপচাপ। নির্জন। শান্ত।
অভয় টপ করে নামল না। বুদ্ধিটা কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে। চোখেও কি কম দেখছে আজকাল? খানিকক্ষণ বসে দম নিয়ে সে আবার ধীরেসুস্থে গাছ থেকে নেমে তার লাঠিগাছ কুড়িয়ে নিল।
জঙ্গলের মধ্যে এখন অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। একটু বাদেই ঘুটঘুটি হয়ে যাবে। অভয় আর এগোবে কিনা ভাবতে-ভাবতে এগনোই সাব্যস্ত করল। পিছিয়ে লাভ নেই। তার খোঁজে খুনিরা এসে পড়েছে। পেছনে জানা বিপদ, সামনে অজানা বিপদ। এগনোই ভাল।
দুপাও ভাল করে এগোয়নি অভয়, অমনই হঠাৎ তাকে আপাদমস্তক শিউরে দিয়ে সামনেই ধাঁধাঁ করে একটা আগুনের শিখা মাটি থেকে উঠে খাড়া হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গেল। এরকম সোজা আর লম্বা আগুন জীবনে দেখেনি অভয়। অন্তত বিশ হাত উঁচু হয়ে লকলক করছে। চারদিক সেই আগুনের হলকায় একেবারে রাঙা হয়ে গেল। অভয়ের অবশ্য হাত থেকে লাঠিটা খসে পড়ে গেল মাটিতে। মুখটা এমন হাঁ হয়ে গেল তার যে, একটা ছোটখাটো এরোপ্লেন ঢুকে যেতে পারে।
কিন্তু অভয় ভয় পেতে-পেতে ভয় থেকেই খানিক শিক্ষা নিয়েছে। কাজেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে হাঁ বুজিয়ে ফেলতে পারল এবং লাঠিটাও কুড়িয়ে নিল। সামনে আগুনের শিখা তখন কোমর দুলিয়ে-দুলিয়ে নাচছে। বেশ একটা হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে সরু শিখার সর্বাঙ্গে। অভয় চোখ চেয়ে আগুনের নাচ কিছুক্ষণ দেখল। তারপর হঠাৎ সে এক দুঃসাহসী কাণ্ড করে বসল। হাততালি দিয়ে বেশ হেঁকে বলে উঠল, “বাঃ, সুন্দর নাচ নেচেছ তো বাপু!”
অমনই দপ করে আগুনের শিখা মিলিয়ে গেল। চারদিকে নেমে এল ঘুটঘুটি অন্ধকার। জোনাকি পোকা জ্বলতে লাগল। ঝিঝি ডাকতে লাগল। গাছে-গাছে পাখিদের তীব্র ঝগড়া, কাজিয়া চলতে লাগল। শেয়াল ডাকল দূরে। একটা অট্টহাসির মতো শব্দও শোনা গেল। বোধ হয় সেটা হায়েনার ডাক।
কাণ্ডগুলো যে ভুতুড়ে, তাতে অভয়ের সন্দেহ নেই। তবে ভয়ের ব্যাপারে মানুষ আর ভূত দুই-ই তার কাছে একাকার। ভূতে মারলেও মারবে, মানুষে মারলেও মারবে। সমুদ্রে শয়ান যার, শিশিরে কী ভয় তার? বরং তার মনে হল এখন ভূতটুতকে ভয় খাওয়া তার পক্ষে এক বাবুগিরি বা শৌখিনতার জিনিস। ওসব যারা সুখে আছে তাদেরই মানায়। তার মতো প্রাণ-হাতে করা মানুষের কি ভূতের ভয় খেয়ে থেমে থাকলে চলে?
অভয় সুতরাং খানিকটা ভয়ে এবং খানিকটা অকুতোভয়ে এগোতে লাগল। সামনে যম-অন্ধকার, জঙ্গল, আঘাটা, কিন্তু হাতে লাঠি বাগিয়ে অভয় দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়েই যেতে থাকল। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “কাউকে না, আমি কাউকে ভয় খাই না। আয় না ব্যাটা কে আসবি! আয় না!”
হঠাৎ ফের উৎকর্ণ হতে হল অভয়কে। বহুদূরে কে একজন যেন বলে উঠল, “গায়।”
শোনার ভুলই হবে। এ জঙ্গলে কে কার গানের কথা বলবে? কিন্তু ফের কে যেন বলে উঠল, “খায়।”
খায়! অভয় মাথা নাড়ল, এ তো হতে পারে না। কে খায়? কী খায়? খাওয়ার কথা ওঠে কেন?
আবার আবছা সেই স্বরটা শোনা গেল, “যায়।” যায়? উঁহু, এটারও তো কোনও অর্থ হচ্ছে না। এর মানে की १
অভয় দ্রুত হাঁটতে লাগল। পায়ের নীচে এখন ঘাস ছাড়া আর বিশেষ কোনও বাধা নেই। ঝোঁপঝাড়ও যেন কম। আর নালার
পাশে বড় গাছও বিশেষ নেই যে, ধাক্কা খাবে।
খানিকটা এগনোর পর হঠাৎ এবার গলার স্বরটা বেশ স্পষ্টই শুনতে পায় অভয়। গায়, খায় বা যায় নয়। তবে কি হয়? না, তাও নয়। বহুদূর থেকে কে যেন করুণ স্বরে ধীরে-ধীরে ডাকছে, “আয়… আয়… আয়… আয়…”
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল অভয়ের। শরীরে একটা শীতল শিহরন বয়ে গেল। এরকম করুশ, কান্নায় ভরা, অপার্থিব কণ্ঠস্বর সে কখনও শোনেনি। তার মনে হল, এ স্বর বহুঁকাল ধরে ক্রমান্বয়ে কাউকে যেন ডেকে চলেছে, ডেকেই চলেছে, “আয়… আয়… আয়… আয়…”