অগত্যা লোকটা যেন খানিকটা অনিচ্ছে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেল।
বিপদে পড়লে মানুষের খিদে-তেষ্টা থাকে না। এ-লোকটারও দেখা গেল তাই। স্নানটান করার পর লাখন যখন গরম-গরম রুটি আর আলু-মরিচের তরকারি বেড়ে দিল তখন লোকটা তেমন খেতেই পারল না। অথচ লাখনের রুটি-তরকারি সতীশের জিভে অমৃতের মতো ঠেকে।
“খাচ্ছেন না যে বড়!”
লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আর খাওয়া! যখনই কিছু খাই তখনই মনে হয় এই শেষ-খাওয়া খাচ্ছি। মুখের খাবার যেন ছাই হয়ে যায়।”
“ঘটনাটা একটু খুলে বলবেন? আপনাকে দেখে তো ভাল লোক বলেই মনে হয়, খুনের মামলায় জড়ালেন কী করে?”
লোকটা অকপটে বলল, “আজ্ঞে, আপনার অনুমান যথার্থ, আমি সত্যিই বেশ ভাল লোক। এমনকী খুব ভালও বলা যায়। তবে এতটা বললে আবার নিজের মুখে নিজের প্রশংসা হয়ে যায় বলে একটু চেপেই বলছি। আর খুনের মামলার কথা কী আর বলব মশাই। দুনিয়ায় ভাল লোকদেরই আজ দুর্দিন। স্বচক্ষে দেখা খুন। কিন্তু পানু মল্লিকের লোকেরা আমার গলায় গামছা দিয়ে কথা আদায় করেছিল, আদালতে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, ধর্মাবতার আমি খুনটুন কিছু দেখিনি। বলতুমও তাই। কিন্তু বাধ সাধল কী জানেন? মহাত্মা গান্ধীর একখানা ছবি। এজলাসের দেওয়ালে ছবিটা টাঙান, নীচে আবার লেখা সত্যমেব জয়তে। দেখে কেমন যেন হয়ে গেলুম। আমার মনে হল, না, যা থাকে কপালে, আজ বুক ঠুকে সত্যি কথাটাই বলে ফেলি। আর সেটা বলেই তো এই বিপদ।”
সতীশ জিজ্ঞেস করল, “পানু মল্লিক লোকটা কে?”
“ও বাবা, সেই তো পালের গোদা। দিনে-দুপুরে হাতে মাথা কাটে।”
“সাক্ষী দিয়ে আপনি পালালেন কী করে? তার স্যাঙাৎরা ছিল না?”
লোকটা মাথা হেলিয়ে বলল, “খুব ছিল। এজলাসে তাদের চোখ জোড়া-জোড়া টর্চবাতির মতো আমার ওপর ফোকাস হচ্ছিল। আমি সাক্ষী দেওয়ার পরই বুঝলুম, এজলাস থেকে বাড়ি যাওয়ার পথেই আমি খুন হব। তাই একজন পুলিশ অফিসারকে সাপটে ধরে বললুম, সার, আমাকে একটু এগিয়ে দিন। তা লোকটা মন্দ নয়। জিপ গাড়িতে তুলে খানিকদূর এগিয়েও দিল। আমি নেমে চোঁ-চা দৌড়ে সোজা স্টেশনে এসে গাড়ি ধরেছি।”
বিস্মিত সতীশ বলল, “তা হলে এইসব মালপত্র আপনাকে দিয়ে গেল কে?”
লোকটা তোধিক বিস্মিত হয়ে বলে, “মালপত্র! মালপত্র আসবে কোথা থেকে?”
“এই যে ট্রাঙ্ক, সুটকেস, টিফিন ক্যারিয়ার এসব কোথা থেকে এল?”
লোকটা যেন কাঁচা ঘুম থেকে উঠল এমন অবাক চোখে মালপত্রগুলোর দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “তাই “এগুলো কি আপনার নয়?”
লোকটা সবেগে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে, “কস্মিনকালেও নয়। এসব কি আমি সঙ্গে করে গাড়ি থেকে নেমেছি?”
“আলবাত। আমরা নিজের চোখে দেখেছি। ওই লাখনকে জিজ্ঞেস করুন না।”
লাখনও সায় দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, জরুর। ইসব তো আপনারই মাল আছে বাবুজি।”
লোকটা জিভ কেটে মাথা নেড়ে বলে, “ইস, বড় ভুল হয়ে গেছে মশাই। মাথাটারও ঠিক নেই। ট্রেন থেকে নামার সময় আনমনে কার মালপত্র যেন নামিয়ে ফেলেছি। ব্যাপারটা কী জানেন? ওরকম একটা কেলে ট্রাঙ্ক, ওরকম একটা বাদামি সুটকেস আর ওই স্টিলের টিফিন ক্যারিয়ার আর জলের বোতল আমারও আছে। যখন যেখানে বেড়াতে যাই তখন ওই চার পিস মাল আমার সঙ্গে থাকেই। অভ্যাস কি না। নামবার সময় ওই চারটে সামনে দেখে মনে হয়েছে বুঝি আমারই জিনিস। এ হে, এ যে ভারী গণ্ডগোল হয়ে গেল!”
সতীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “খুবই গণ্ডগোল। যার মাল সে যদি এখন পুলিশে খবর দেয় তো আপনার বিপদ আছে।”
লোকটা মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলে, “আজ্ঞে আমার বিপদের আর অভাব কি? চারদিকে বিপদের একেবারে ঢেউ খেলছে।”
সতীশ হঠাৎ কি যেন মনে পড়ায় বলল, “ওঃ ভাল কথা, আপনার টিকিটটা কিন্তু এখনও দেননি। রেলের টিকিটটা কোথায়।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “নেই। টিকিট কাটার সময় হল কোথায় বলুন! দৌড়ে এসে ট্রেন ধরলুম যে!”
“তা হলে বিনা টিকিটের যাত্রী হিসেবে আপনার আরও কিছু ঝঞ্জাট আছে। ফাইনসহ গাড়িভাড়া দিতে হবে।”
“একেই কি লোকে বিপদের ওপর বিপদ বলে?”
“হ্যাঁ, এটাই হল বিপদের ওপর বিপদ।” লোকটা কাহিল মুখে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলে, “এখানে কি রেল পুলিশ বা থানা আছে?”
“এখানে না থাকলেও পরের স্টেশনে আছে। টরেটক্কা করে দিলেই বেলা দশটার ডাউন গাড়িতে ফোর্স চলে আসবে। এই স্টেশনে আজ অবধি একটি লোকও আমার হাতে পার পায়নি। টিকিট না থাকলে হয় জরিমানা দাও নয়তো স্টেশনের ঘরে বসে থাকো, পুলিশ এসে নিয়ে যাবে।”
লোকটা চারদিকে টালুমালু করে চাইল। তারপর হঠাৎ ফ্যাঁসফাঁসে গলায় বলল, “একটু জল খাব। গলাটা বড় শুকনো লাগছে।”
লাখন তাড়াতাড়ি পেতলের ঘটিটা এগিয়ে দিল। লোকটা ঢকঢক করে ঘটি খালি করে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা একটা কথা আছে না, বিপদ কখনও একা আসে না!”
“আছে।”
লোকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “ইয়ে, আমি একটু বাথরুমটা ঘুরে আসি। কেমন?”
“আসুন। আমি স্টেশন থেকে টরেটক্কা করে দিয়ে আসছি ততক্ষণ।”
“পুলিশ ডাকবেন তো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। ফাইনসহ পুরো ভাড়া না দিতে পারলে পুলিশে হ্যান্ডওভার করতেই হবে।”
“আপনি খুব তেজস্বী লোক দেখছি।”
সতীশ মাথা উঁচু করে বেশ অহঙ্কারের সঙ্গে বলল, “তা বলতে পারেন। আমরা তিনপুরুষের রেলের চাকুরে। আমাদের বংশে কেউ কখনও কোনও দুর্নীতির প্রশ্রয় দেয়নি। কর্তব্য যত কঠিন আর নিষ্ঠুরই হোক তা আমরা করবই।”