প্রৌঢ় গম্ভীর মুখে বললেন, “আপনাদের উদ্দেশ্য কী, তা জানি। তবে অভয় সরকারকে আমি লুকিয়ে রাখিনি।”
তিনুও এবার গম্ভীর হল। গুরুগম্ভীর গলায় বলল, “আমাদের উদ্দেশ্য একজন অতিবদমাশ লোককে ধরে নিয়ে সরকারের হাতে তুলে দেওয়া। যদি সেটা সম্ভব না হয় তা হলে তাকে হত্যা করারও হুকুম আছে। আমরা আমাদের কর্তব্য করতে এসেছি মাত্র।”
“আপনারা কি সত্যিই পুলিশ?”
“হ্যাঁ, স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ।”
“আইডেন্টিটি কার্ড দেখাতে পারবেন?”
“আমাদের আইডেন্টিটি কার্ড যাকে-তাকে দেখানোর নিয়ম নেই। বিশেষ কারণ ছাড়া। আমরা সেগুলো সঙ্গেও আনিনি। স্টেশনে আমাদের মালপত্র রয়েছে, তার মধ্যেই আছে। জঙ্গলে আইডেন্টিটি কার্ড দেখাতে হবে বলে জানতাম না।” এই বলে তিনু ঘড়ি দেখল।
প্রৌঢ় গম্ভীর মুখে বললেন, “অভয় সরকার এখানে নেই। অনেকক্ষণ আগেই সে চলে গেছে।”
“কোথায় গেছে?”
“তার যাওয়ার বিশেষ জায়গা আছে বলে জানি না। তবে আপনারা বা অন্য কেউ তার সন্ধানে আসতে পারেন বলে তার ভয় ছিল। তাই সে স্থানত্যাগ করেছে মাত্র।”
তিনু মাথা নেড়ে বলে, “এত জলের মতো সহজ গল্প আমরা বিশ্বাস করব ভেবেছেন? অভয় সরকার স্থানত্যাগ করলে আমাদের হাত এড়াতে পারত না। আমরা এ-জায়গা খুঁজে দেখব।”
প্রৌঢ় বইটা আবার খুলে চোখের সামনে ধরে বললেন, “স্বচ্ছন্দে। শুধু অনুরোধ, আমার সামান্য জিনিসপত্র আছে, ওগুলো বিনষ্ট করবেন না।”
“ভাল কথা। আপনার কোনও অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে? জঙ্গলের মধ্যে কেউ একজন আমাদের ওপর নজর রাখছিল। কিন্তু সে লোক আপনি নন। সে কে?”
প্রৌঢ় অসহায় ভঙ্গিতে হাত উলটে বললেন, “কে জানে?”
তিনু একটু হেসে বলে, “আমি কিন্তু তাকে গুলি করেছি। গুলি খেয়েও সে পালিয়ে যায়।”
প্রৌঢ় একথায় কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন, “গুলি করেছেন! সর্বনাশ! গুলি করলেন কেন?”
“বললাম তো সে আমাদের ওপর নজর রাখছিল।” প্রৌঢ় বিদ্যুদ্বেগে উঠে দাঁড়িয়ে আপনমনে বললেন, “সেইজন্যই অনেকক্ষণ কোনও সঙ্কেত দেয়নি! হায়, আপনি কি তাকে মেরে ফেলেছেন?”
“সে মরলেও মরেছে নিজের দোষে। কিন্তু আমরা জঙ্গলে কোনও রক্তের দাগ দেখিনি।”
“সর্বনাশ! সে তো কোনও অন্যায় করেনি! সে কেবল জঙ্গলে কাঠুরে আর চোরাশিকারীদের খবর আমাকে দেয়।”
তিনু পরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “তা হবে। কিন্তু সে কথা আমাকে সে জানাতে পারত!”
প্রৌঢ় হাত বাড়িয়ে তিনুর ডান হাতটা চেপে ধরে বললেন, “হাতে পিস্তল থাকলেই বুঝি গুলি চালাতে ইচ্ছে হয়?”
প্রৌঢ়ের থাবায় তিনুর কবজি। তিনু যথেষ্ট বলবান। তবু এই প্রৌঢ়ের হাতের জোর তাকে স্তম্ভিত করে দিল। হাত থেকে পিস্তলটা খটাস কওে পড়ে গেল মাটিতে এবং যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল তিনু। লোহার মতো শক্ত আঙুলের চাপে তার কবজি ভেঙে যাচ্ছে।
তবে কয়েক সেকেণ্ড মাত্র। পচা ত্বরিত গতিতে তার ভারী পিস্তলের বাঁটটা সজোরে বসিয়ে দিল প্রৌঢ়ের মাথায়। প্রৌঢ় ঢলে পড়ে গেলেন অজ্ঞান হয়ে। পচা পিস্তলটা ঘুরিয়ে ভূপাতিত সংজ্ঞাহীন প্রৌঢ়ের দিকে তাক করে তিনুর দিকে চেয়ে বলল, “শেষ করে দেব? তা হলে আর সাক্ষী থাকবে না।”
তিনু একটু চিন্তিতভাবে বলা, “দিবি? দে তা হলে। কিন্তু আমরা কত সাক্ষী লোপাট করব? আমাদের খুনখারাপির তো হাজার-হাজার সাক্ষী আছে। হয়েছে তো কাঁচকলা। একে মারার ইচ্ছে আমার ছিল না। তবে লোকটা সাহেব, হয়তো ঝামেলা পাকাবে।”
পচা পিস্তলের সেফটি ক্যাপটা খুলে ট্রিগারে আঙুল দিতেই দরদালানের ওপাশে ধপ করে একটা শব্দ হল। চারজন চেয়ে দেখল, দরদালানের শেষ মাথায় একজন লোক ভীত মুখে দাঁড়িয়ে। তারা তাকাতেই লোকটা হাতজোড় করে বলল, “ওঁকে মারবেন না। উনি সাধু মানুষ। জঙ্গলের মধ্যে আমিই আপনাদের ওপর নজর রেখেছিলাম। আমি কালু।”
নিষ্কম্প তিনটে পিস্তল কালুর বুকের দিকে একচক্ষু হয়ে চেয়ে ছিল। তিনু তার তিন সঙ্গীকে হাত তুলে নিবারণ করে কালুকে বলল, “গুড বয় কাল। তোমাকেই বোধ হয় জঙ্গলের মধ্যে আমি গুলি করেছিলাম। তোমার কপাল দেখছি খুব ভাল। ভয় পেও, আমরা ঝামেলা করতে আসিনি। অভয় সরকার কোথায়?”
“আজ সকালে উনি চলে গেছেন।”
“কোথায় গেছে?”
“শুখানালা।”
“সেটা কোথায়?”
“উত্তর দিকে। দু-তিন মাইল হতে পারে। পাহাড়ের নিচে।”
“ঠিক আছে কালু, তুমিই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। যদি অভয় সরকারকে না পাই তাই তোমাকে জামিন রাখছি। তার আগে তোমাদের এই ডেরাটা অবশ্য আমরা সার্চ করব। সাবধানের মার নেই। আর তোমার সাধুবাবার জন্য চিন্তা কোরো না। উনি শক্ত ধাতের জিনিস। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়বেন।”
চারজন পিস্তলধারী কালুকে পথপ্রদর্শক নিয়ে তন্নতন্ন করে সারা বাড়িটা খুঁজল। তারপর আশপাশে ঝোঁপঝাড়ে এবং ছাদের ওপরেও।
অনুসন্ধান করে ফিরে এসে তারা দেখল, সাধুবাবা উঠে বসেছেন। দু হাতে মাথা রেখে উবু হয়ে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত পড়তে দেখছেন মেঝের ওপর।
তিনু একটু নম্র স্বরে বলল, “আপনার সঙ্গে আমাদের কোনও ঝগড়া নেই। মাফ করবেন।”
তারপর কালুকে নিয়ে তারা চারজন বেরিয়ে পড়ল।
৫. ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথচলা
ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথচলা যে কী কঠিন ব্যাপার তা যার অভিজ্ঞতা নেই সে বুঝবে না। দুভাগ্যের বিষয়, অভিজ্ঞতা অভয়েরও নেই। লতাপাতা, কাঁটাঝোঁপ এবং মাঝে-মাঝে দুর্ভেদ্য বাঁশঝাড় এমন শক্ত বেড়ার মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায় যে, চলা বন্ধ। হয়ে যায়। সাপখোপ জন্তু-জানোয়ারের ভয় তো আছেই। তবু ঘণ্টা দুই অভয় একটানা হাঁটল। না, ঠিক হাঁটা বলা যায় না। কখনও হামাগুড়ি, কখনও স্রেফ বুক ঘেঁষটে, কখনও ছোটখাটো গাছের ডাল ধরে স্কুল খেয়ে নানা কায়দায় তাকে এগোতে হচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়ের কথা, তার যে এত এলেম ছিল এটাই জানত না। অভয়। কাল সারাদিন ওরকম দৌড়ঝাঁপ, তারপর সন্ধেবেলা হাটুরে মার, অনাহার সত্ত্বেও আজ এই কঠিন অভিযান, সে পারছে কী করে? স্বাভাবিক নিয়মে তার তো এখন বিছানায় পড়ে থাকার কথা!