“শুখানালা! ও বাবা, সে তো ভীম সরকারের তল্লাট! মাছিটাও গলতে পারে না।”
রেমো শুকনো মুখে বলল, “হুজুর, কথাটা ধরবেন না। লোকটা ভয় পেয়ে উলটোপালটা বলেছে।”
সুদর্শনবাবু কাহিল মুখে বললেন, “যাঃ, লাখ টাকা জলে গেল। ওঃ, দারোগাদের দুঃখ যদি এইসব চোর-ডাকাত একটু বুঝত।”
নেতাই বলল, “বুঝবে হুজুর, সত্যযুগটা আসতে দিন। তখন বুঝবে। কলির শেষ কিনা, তাই হুজুরের মতো লোকদের এত কষ্ট। তা হলে হুজুর, আমরা বিদেয় হচ্ছি। শুধু যদি দয়া করে আমাদের গাঁয়ে দু-একজন সেপাইকে দু-চারদিন একটু রোঁদে পাঠান তবে ভাল হয়। কিছু করুক না করুক, পুলিশ দেখলেই আমাদের বুকে একটু বল-ভরসা আসে। এই কথাটুকুই বলতে আসা।”
“সে হবে’খন।” বলে লোকগুলোকে বিদেয় করে সুদর্শনবাবু চোখ বুজে স্ট্র্যাটেজি ভাবতে লাগলেন।
চারজনের হাতেই অত্যন্ত ধারাল চপার, বাঁ হাতে পিস্তল। তারা চারজনই খুব শক্তপোক্ত এবং দৃর্গম জায়গায় যাওয়ার অভ্যাস আছে। জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে তারা একটু দূরে-দূরে ছড়িয়ে গেল বটে, কিন্তু যোগাযোগ হারাল না। শিস দিয়ে দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল। চপার দিয়ে ঘন ঝোঁপঝাড় বা লতাপাতা কেটে পথ করে নিচ্ছিল তারা। ভয়ডরের লেশমাত্র তাদের হাবভাবে দেখা যাচ্ছিল না। ইন্দ্রিয় তাদের খুবই সজাগ। চোখ তীক্ষ্ণ এবং দয়ামায়ার লেশমাত্র সেখানে নেই। হাতে-পায়ে চিতাবাঘের মতো তৎপরতা।
একটা বাঁশঝাড়ের কাছ বরাবর এসে তিনু হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। তার স্পষ্টই মনে হয়েছে কেউ তাকে আড়াল থেকে লক্ষ করছে। সে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে দেখে নিল। তারপর সঙ্গীদের সতর্ক করতে একটা টু-হিট শিস দিল। তারপরই সে শুনতে পেল, তার সঙ্গীরা নয়, অন্য কেউ ঠিক দোয়েলের মতো শিস দিল। খুবই নিখুত। অভ্যস্ত কান না হলে অবশ্যই পাখি বলেই ধরে নিত।
শিসটা লক্ষ করে বাঁদিকে একটা ঘাসজঙ্গলের মধ্যে ঢুকেই আবছা সে একটা লোকের দ্রুত অপসৃয়মাণ অবয়ব দেখতে পেল। চোখের পলকে পিস্তল তুলে গুলি করল তিনু। সামনে একটা পতনের শব্দ হল। লেগেছে!
তিনু দৌড়ে গিয়ে দেখল, এক জায়গায় ঘাসের কিছুটা শুয়ে পড়েছে। কেউ এখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। তবে সে পালিয়েছে। ঘাসে এবং জমিতে রক্তের দাগ খুঁজল তিনু। পেল না। লোকটা যেই হোক, অভয় সরকার হতে পারে না। কারণ, অভয় সরকারকে সে দেখেছে। মোটাসোটা নাড়গোপাল-মাকা লোক। দৌড়ঝাঁপ তার কর্ম নয়।
রক্তের দাগ না পেলেও লোকটা কোন পথে গেছে তার হদিস পেয়ে গেল তিনু। আর এই পথেই যাওয়া উচিত কাজ হবে। সে শিস দিয়ে সঙ্গীদের ইশারা করে এগোতে লাগল।
একটু বাদে একটা ঝোঁপ পেরিয়ে সে একটা ফাঁকা জায়গায় পা দিয়েই অবাক হয়ে গেল। জঙ্গলের মধ্যে এত পরিষ্কার জায়গা মানুষের কাজ ছাড়া হতে পারে না। অতএব, কাছেপিঠে মানুষ আছে।
একে-একে পচা, ল্যাংড়া আর সন্তুও এসে ফাঁকা জায়গাটায় জড়ো হল।
তিন তার সঙ্গীদের দিকে চেয়ে বলল, “ব্রহ্মদৈত্যের কথা বলছিল না স্টেশনের ওই কুলিটা?”
পচা বলল, “গাঁয়ের লোকগুলোও বলছিল।”
তিনু গম্ভীর মুখে বলে, “মনে হচ্ছে ব্ৰহ্মদৈত্যকে এবার আমরা পেয়ে যাব।”
একটু খুঁজতেই শুড়িপথটার সন্ধান পেয়ে গেল তারা। সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে তিনু আগে এবং পেছনে তার তিন খুনে সঙ্গী দ্রুত-পায়ে এগোতে লাগল।
দশ মিনিটের মধ্যেই তারা ধ্বংসস্তূপটার সামনে এসে দাঁড়াল। তিনু ঘড়ি দেখল। বেলা প্রায় বারোটা বাজে। সে সঙ্গীদের দিকে চেয়ে বলে, “অভয়কে এখানেই পেয়ে যাব মনে হচ্ছে। কাজ সেরে সন্ধের ডাউন গাড়ি ধরা যাবে।”
তারা ধ্বংসস্তৃপটা খুব অনায়াসেই ডিঙিয়ে গেল। উঠোনে জন্তু-জানোয়ারের খাঁচাটার দিকে একটু ভূক্ষেপ করল মাত্র তারা। তারপর সোজা গিয়ে দরদালানে উঠল।
দরজা খোলাই ছিল। একটা কাঠের চেয়ারে একজন অত্যন্ত
দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ প্রৌঢ় বসে একখানা বই পড়ছেন। চারজনকে দেখে বিস্মিত চোখে তাকালেন, “আপনারা!”
তিনু তীক্ষ্ণ চোখে লোকটাকে দেখে নিয়ে বলল, “বাংলা জানেন দেখছি! নিশ্চয়ই ইউরোপিয়ান?”
প্রৌঢ় মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, “জঙ্গলে কী করছেন আপনারা?”
তিনু মৃদু হেসে বলে, “আপনার ভয় নেই। আমরা
ব্ৰহ্মদৈত্যকে খুঁজছি না। আপনার হাইট কত? সাড়ে ছ’ ফুট?”
“ছ ফুট সাত ইঞ্চি।”
“ব্রহ্মদৈত্য সাজবার পক্ষে চমৎকার হাইট।”
প্রৌঢ় বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আপনারা পরিশ্রান্ত হয়ে এসেছেন। বসুন।”
তিনু মাথা নেড়ে বলল, “বসবার সময় নেই। আমরা পুলিশের লোক। একজন ফেরারি খুনি আসামিকে খুঁজছি। তার নাম অভয় সরকার। মনে হচ্ছে, আপনার কাছে তার খোঁজ পেয়ে যাব।”
প্রৌঢ় একটু দোনোমোনো করলেন, তারপর বললেন, “অতিথি নারায়ণ।”
তিনু হেসে বলে, “তার মানে কি? অতিথি শুধু আমরাই নই, অভয় সরকারও! শুনুন, আমার অনুমান অভয় সরকার এখানে আছে।”
প্রৌঢ় একটু চুপ করে থেকে বললেন, “ভারতবর্ষের পুলিশ সার্ভিস রিভলভার ব্যবহার করে। তাদের কাছে অত্যাধুনিক বারো শটের জামান পিস্তল থাকে না। আর ওই প্রফেশন্যাল চপার, ও-জিনিসও পুলিশের জিনিস নয়।”
“বন্দুক পিস্তল তো আপনি ভালই চেনেন দেখছি! নাড়াচাড়া করার অভ্যাস আছে নাকি?”
“ছিল। যখন মিলিটারিতে ছিলুম।” তিনু হাসল, “আলাপ করে ভালই লাগল। কিন্তু গল্প করতে তো আসিনি বুঝতেই পারছেন। অভয় সরকারকে আমাদের চাই।”