সুদর্শনবাবু একটা হুঙ্কার দিলেন, “তোরা কারা?”
দরজার কাছ থেকেই হাতজোড় করে তিনজন ঘরে ঢুকল। একজনের হাতে একটা মেটে হাঁড়ি।
“আজ্ঞে, আমাকে চিনতে পারছেন না বড়বাবু? আমি রেমো নাপতে। এ হল অক্ষয়। আর ওই যে উঁচু দাঁত, ও হল গে নেতাই। রসময় হালুইকরের গরম-গরম ক’খানা জিবেগজা এনেছিলুম বাবু। একটু ইচ্ছে করুন।”
“জিগেজা!” বলে দারোগাবাবু ঈষৎ প্রসন্ন মুখে বলেন, “ওই একটাই যা সুখ এখনও আছে রে! দুনিয়াটা পচে গেছে বটে, কিন্তু এখনও যে এ-দুনিয়ায় জিগেজা হয়, জিলিপি হয়, এটাই যা ভরসার কথা। নিয়ে আয় এখানে।”
রেমো বিগলিত মুখে এগিয়ে এসে হাঁড়িটা টেবিলে রেখে মুখের সরাখানা সরিয়ে নিল। দাবোগাবাবু গন্ধটা কে বললেন, “আঃ, এ একেবারে স্বর্গের জিনিস। দেবভোগ্য।”
“হে-হেঁ, আপনি ছাড়া ভাল জিনিসের কদর আর কে বুঝবে বলুন! সমঝদার কই? তিরিশখানা আছে, আজ্ঞে। আপনার কাছে অবশ্য কিছুই নয়, তিন মিনিটে উড়ে যাবে।”
দারোগাবাবু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “হালকা-পলকা জিনিস, এ ত্ৰিশখানাও যা, তিনশোখানাও তাই।” এই বলে একখানা মুখে দিয়ে চিবোতে-চিবোতে চোখ আধবোজা করে বললেন, “মন্দ নয়।”
অক্ষয় রেমোর পেছন থেকে বলে উঠল, “আজ্ঞে, রসময় এ গজার নামই দিয়েছে দারোগাভোগ।”
রেমো বলল, “আর তার জিলিপির নাম শুনলে আপনি হাসবেন। জিলিপি হল গিয়ে সুদর্শনচক্র। খুব বিকোচ্ছে।”
সুদর্শনবাবু গোটা দশেক জিগেজা উড়িয়ে দিয়ে কথা বলার ফুরসত পেলেন, “হ্যাঁ, এবার বল তোদের সমস্যাটা কী?”
অক্ষয় এগিয়ে এসে একটা নমো ঠুকে বলল, “আজ্ঞে, কাল রাতেও একটা ডাকাত একেবারে ভরসন্ধেবেলা ঢুকে পড়েছিল আমাদের গাঁয়ে। আপনি তো জানেন আমরা ভেড়য়া নই। মনসাপোঁতার লোকেরা ভগবান আর দারোগাবাবুকে ছাড়া কাউকে ভয় খায় না। তা আমরা ডাকাতটাকে সবাই মিলে এমন দাবড়ে দিলুম যে, পালানোর পথ পায় না। আর পালাল বলেই ভয় হল। ব্যাটা হুকুম সিং-এর দলের লোক। গিয়ে খবর দিলে হুকুম কি আর আমাদের ছেড়ে কথা কইবে।”
জিবেগজা খাওয়া থামিয়ে দারোগাবাবু ব্যথিত মুখে বললেন, “হ্যাঁ রে, এই জিবেগজা খাওয়ার সময়েই কি ওসব অলক্ষুনে কথা বলতে হয়? তোদের এটুকু খেয়াল হল না যে, হুকুম সিং-এর নাম শুনলে সুদর্শন দারোগার জিভ অসাড় হয়ে যায়! দুর, খাওয়াটাই মাটি করলি তোরা।”
অক্ষয় জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বলল, “এ, বড় ভুল হয়ে গেছে বড়বাবু। আচ্ছা, আপনি বরং খেয়ে নিন। আমরা একটু বাইরে বসছি গিয়ে।”
সুদর্শনবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “খাওয়াটা মাটি যখন করেছিস তখন বাকিটাও বলে ফেল। জিবেগজা না হয় রয়েসয়ে খাওয়া যাবে।”
লাখন এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার মাথা নেড়ে বলল, “ওই বাত ঠিক বলিয়েছেন। সবেরবেলায় তো আজ বহুত ভারী নাস্তা হয়েছে মালিক। আমি তো বিশটো পুরি-কচৌরি আর তিন পৌয়া সবজি আপনার ভোগমে লাগালম। শশাচ করছিলাম কি, দারোগা-মালিকের পেটমে আর কত জায়গা হোবে।”
দারোগাবাবু রোষকষায়িত লোচনে লাখনের দিকে চেয়ে বললেন, “তোর কথা তো শুনেছি। এখন যা তো। একটু শান্তিতে থাকতে দে।”
লাখন “রাম রাম” বলে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিল।
দারোগাবাবু গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এবার তোরা বল। সকালে যে আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলুম!”
নেতাই বলল, “আজ্ঞে, বোধ হয় লাখনের মুখ দেখে। ব্যাটা বড্ড অপয়া। এই তো সেদিন তায়েবগঞ্জ থেকে ভোরবেলা ইস্টিশনে নেমেই দেখি লাখন। আর সেদিনই কিনা জীবনে প্রথম বিনা টিকিটের জন্য ধরা পড়লুম! গত বিশ বছর তায়েবগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছি-আসছি, কস্মিনকালে টিকিট কাটিনি, হাসতে-হাসতে চলে এসেছি লাইন ধরে হেঁটে। আর সেদিন বারো টাকা গচ্ছা দিয়ে তবে রেহাই পাই।”
দারোগাবাবু হাতের একটা ঝাঁপটায় নেতাইকে চুপ করিয়ে বললেন, “ডাকাতের কথাটা বলে ফেল।”
অক্ষয় গলা-খাঁকারি দিয়ে বলল, “আজ্ঞে। এই বলি। তা হুকুম সিং-এর দলের লোকটা তো রাতে পালাল। সারারাত আমরা শলাপরামর্শ করলুম, এখন কী করা! হুকুম এসে তো গাঁ জ্বালিয়ে দেবে, গুলি চালাবে, লুটপাট করবে। মাথার ওপর আপনি আছেন বটে, কিন্তু পিদিমের নীচেই তো অন্ধকার কিনা, হুকুম ব্যাটার ভাগ্য ভাল যে, এমন ভাল একজন দারোগা পেয়েছে। নইলে এতদিনে তার জারিজুরি বেরিয়ে যেত।”
দারোগাবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আসল কথাটা বলবি তো!”
“আজ্ঞে, সেই কথাই বলছি। আজ সকালেরই ঘটনা। রাত পোয়াতে না পোয়াতেই কী বলব হুজুর, বন্দুক পিস্তল নিয়ে হুকুমের দলের চারজন ষণ্ডামাকা লোক এসে হাজির। তখনও হুজুর, আমাদের বিষয়কর্ম শুরু হয়নি, প্রাতঃকৃত্যও করিনি, কাক অবধি সকালের আবর্জনা খায়নি, সবে মোরগ ডাকতে লেগেছে, এমন সময় চার-চারটে দানো এসে গাঁয়ে সে কী তুলকালাম বাধাল, যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই রদ্দা, লাথি, চড় মারছে আর বলছে, বল অভয় সরকারকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস! আমরা তো হুজুর, যাকে বলে একগাল মাছি। ভয়ে আত্মারাম সব খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। দু-চারজন পালিয়ে যেতে পারল বটে, কিন্তু এই
যে রেমো, এ তিনটে লাথি খেয়েছে।”
রেমো খ্যাঁক করে উঠল, “আর তুমি বুঝি খাওনি! একা আমাকেই বুঝি অপমান করেছে?”