“কেন বলুন তো!”
“সেটা বললেও তোমার বিশ্বাস হবে না। তবে যদি তুমি বাস্তবিকই সরকারদের বংশধর হয়ে থাকে, তা হলে তোমার হয়তো ভয় নেই।”
উৎকণ্ঠ অভয় বলে, “ভয়ের কথা উঠছে কেন? ভয়ের জিনিস আমি মোটেই ভালবাসি না।”
“কেউই বাসে না বাবা। তবে শুখানালার ধারে কাছে লোকে যায় না।”
“আপনিও না?”
“আমার কথা বাদ দাও। আমার অগম্য স্থান কমই আছে।”
হাঁটতে-হাঁটতে যখন ধ্বংসস্তূপটার কাছে এসে পড়েছে তারা, তখন হঠাৎ একটা ভারী মিষ্টি পাখির ডাক শোনা গেল। অভয় উৎকর্ণ হয়ে শুনল, পাখির ডাক সে বড় একটা শুনতে পায় না। বলল, “আচ্ছা, এ কি দোয়েল পাখি ডাকছে?”
ব্ৰহ্মদৈত্য সামান্য ভ্রূ কুঁচকে বলেন, “না, ও হচ্ছে কালু।”
“কালু কে বলুন তো?”
ব্রহ্মদৈত্য হেসে বললেন, “কালুও একদিন মানুষের নিযাতনে পালিয়ে এসেছিল ডাকাতের দল গড়বে বলে। বিহারের গাঁয়ে ওর বাড়ি। কাজেই নিচু জাত বলে রাজপুতরা খুব অত্যাচার করত। বাড়ি জ্বালিয়ে, চাষের খেত কেড়ে নিয়ে সে অনেক কাণ্ড। মরতে-মরতে ছোঁকরা বেঁচে যায়। মতলব ছিল ডাকাতের দল গড়ে নিয়ে প্রতিশোধ নেবে। আমিই সেটা ঠেকাই। এখন
আমার কাছেই থাকে।”
“ভারী সুন্দর শিস দেয় তো?”
“তোমার ভাল লাগছে শিসটা? আমার লাগছে না। কারণ, ওই শিসের একটা বিশেষ অর্থ আছে। কালু জানান দিচ্ছে যে, জঙ্গলে কিছু বাইরের লোক ঢুকেছে এবং তারা ভাল লোক নয়। তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। সংখ্যায় তারা চারজন।”
অভয়ের মুখ একথা শুনে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে একটু কাঁপা গলায় বলল, “সর্বনাশ! এরা তো বোধ হয় পানু মল্লিকের দল।”
ব্রহ্মদৈত্য চিন্তিত মুখে অভয়ের দিকে চেয়ে বলেন, “তাই। হবে। কারণ, স্থানীয় লোকদের কুসংস্কার আছে। তারা এ-জঙ্গলে ঢুকবে না।”
“এখন তা হলে কী হবে?”
“ভয় পেও না। ভয় পেতে নেই। বিপদের সময় ভয় পেলে বুদ্ধি ঘুলিয়ে যায়, আর বুদ্ধি ঘুলিয়ে গেলে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন।”
“এদের ব্রহ্মদৈত্যের ভয় দেখালে হয় না?” ব্রহ্মদৈত্য একটু হেসে মাথা নেড়ে বলেন, “সরল সোজা গ্রামবাসী হলে হত। কিন্তু এরা বোধ হয় পেশাদার খুনি। অত সহজে দমবার পাত্র এরা নয়। তা ছাড়া এরা মরিয়া, তুমি বেঁচে থাকলে এদের বিপদ।”
কাঁদো-কাঁদো হয়ে অভয় বলে, “তা হলে এখন আমি কী করব?”
“চিন্তা কোরো না। ওরা খুব সহজে এ-জায়গা খুঁজে পাবে না। তবে খুব বেশিক্ষণও লাগবে না। হয়তো দুপুরের দিকে ওরা ঠিকই খুঁজে-খুঁজে চলে আসবে এখানে। ততক্ষণে চলো, তোমাকে আর-একবার পাঁচন খাইয়ে দিই। গায়ে একটু বল পাবে। আরও একটা কথা আছে। তোমার মাথার বাঁদিকটা ওরা কামিয়ে দিয়েছে, ডানদিকটাও কামিয়ে নাও। আমার কাছে ভাল ক্ষুর আছে, চলো।”
তাই হল। ব্রহ্মদৈত্য তাকে আরও একটা বিকট স্বাদের পাঁচন খাওয়ালেন। তারপর মাথাটা পুরো ন্যাড়া করে দিলেন। তারপর গরম-গরম ডালভাত আর কচুসেদ্ধ খাইয়ে দিয়ে বললেন, “দুপুর প্রায় হয়ে এল। এবার তোমাকে এ-জায়গা ছাড়তে হবে। আমার অনুমান, চারটে খুনি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এদিকে এসে পড়বে। পেশাদার গুণ্ডাদের হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর ক্ষমতা আমার নেই। কাজেই তোমাকে পালাতে হবে।”
অভয় হাতজোড় করে বলল, “কোথায় যাব?” ব্রহ্মদৈত্য চিন্তিত মুখে বলেন, “আমি তো একটা ছাড়া অন্য উপায় দেখছি না।”
“সেটা কী?”
“শুখানালা। তোমাদের আদি বাড়ি। উত্তরদিকে যেমন বলেছি তেমনই এগিয়ে যাও। একটা নাম মনে রেখো, ভীম সরকার। এখন পালাও।”
অভয় পালাল।
৪. সুদর্শনবাবু খুবই অবাক
সুদর্শনবাবু খুবই অবাক হয়ে লাখনের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “গোয়েন্দা পুলিশ! গোয়েন্দা পুলিশ এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করেই লোকটার খোঁজে বেরিয়ে গেল এ কেমন কথা! কেন, আমি কি মরে গেছি? সুদর্শন দারোগাকে ডিঙিয়ে নিজেদের সদারি ফলানো!”
লাখন হাতজোড় করে বলল, “আপনি তো জবরদস্ত দারোগা আছেন। আর ই চারটো আদমি বহুত খতরনাক আছে। শের কা মাফিক আঁখ আউর বহুত ওয়সা।”
সুদর্শনবাবু খুবই উত্তেজিতভাবে বললেন, “আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়েছিল?”
“না মালিক। উ লোক এক কৌন অভয় সরকারকে জানে মারতে এসেছে। ওহি বাত তো বলছিল। হামলোগা বহুত ডর লাগল। এ ভি বলেছে যে, দারোগাবাবুকে কোই খবর-টবর দিলে খারাবি হোয়ে যাবে।”
সুদর্শনবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “অ্যা, তা হলে তো দেখছি জালি ব্যাপার। এরা তো পুলিশের লোক নয়।”
“ওহি বাত তো বোলতে আসলম মালিক। ইসব খতরনাক আদমি ডাকু আছে কি খুনি আছে কোন জানে! এখুন তো ভরসা আপনি।”
“আমি?” বলে সুদর্শনবাবু এই শীতেও কপালের ঘাম হাতের তেলোয় মুছে হাতটা ফের মুছলেন বুকপকেটের ওপর ঘষে। তারপর খুবই থমথমে মুখে বললেন, “দুনিয়ায় কোনও দারোগাই কখনও শান্তিতে থাকে না জানি। কিন্তু তোরা যে আমাকে খেতে-শুতে অবধি দিচ্ছিস না, এটা কি ভাল হচ্ছে রে!”
লাখন গদগদ হয়ে বলে, “জি মালিক, কিন্তু এখুন তো সবের টাইম আছে। দশটা বাজছে। এখুন তো কোই নিদ যানেকা টাইম নেহি মালিক। তোবে ভুখ লাগার কথা আলাদা। ভুখ সোবসময় লাগতে পারে হুজুর।”
লাখন কথাটা শেষ করার আগেই দরজার কাছ থেকে কে যেন ভারী বিনয়ী গলায় বলে উঠল, “ভুখ লাগলেও কোনও চিন্তা নেই। দারোগাবাবুর যে সবসময় খিদে পায় সে আমরা খুব জানি। আর সেইজন্যই আসা।”