“আপনি এখানে এলেন কী করে? এই জায়গাতেই বা রয়েছেন কেন?”
“ঘুরতে-ঘুরতে চলে এলুম। সাধুদের তো পরিক্রমা করতেই হয়। এ-জায়গাটা ভালও লেগে গেল। সাধন-ভজনের পক্ষে ভাল জায়গা। তবে সাধু দেখে লোকেরা এসে বড্ড বিরক্ত করত। হাত দেখতে বলে, কোষ্ঠী বিচার করতে বলে, জলপড়া চায়, রোগ সারানোর বায়না করে। তিতিবিরক্ত হয়ে শেষে জঙ্গলে ঢুকে আত্মরক্ষা করলুম।”
“আপনি যে কী চমৎকার বাংলা বলেন!”
“কেন কইব না বাপু? আমার গুরু যে বাঙালি। তোমাদের ভাষাটিও ভারী মিষ্টি, শিখতে আমার কষ্ট হয়নি। এবার তোমার কথা শোনা যাক। তুমি কে? কী করে এখানে এলে? মারধরই বা খেলে কেন?”
অভয় ধীরে-ধীরে সংক্ষেপে সবই বলল। খুনের মামলায় সাক্ষী দেওয়া থেকে শুরু করে ব্রহ্মদৈত্য অবধি।
ব্ৰহ্মদৈত্য মাথা নেড়ে বললেন, “তোমাকে চোরাশিকারি মনে করে আমার শাগরেদ কালু ভয় দেখাতে ওই হাই-হাই আওয়াজ করতে করতে তাড়িয়ে আনছিল। কালু হচ্ছে হরবোলা। আমিও তোমাকে মুগুরপেটা করতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তোমার অবস্থা দেখে আর সেটা করিনি। ওই গ্রামের লোকগুলোর ওপর তোমার নিশ্চয়ই খুব রাগ হচ্ছে! কিন্তু ওদের খুব দোষ নেই। এখানে খুবই ডাকাতের উৎপাত। পুলিশ কিছুই করতে পারে না। ঠাকুরের দয়ায় তুমি বেঁচে গেছ। এখন কি শরীরে একটু জোর পাচ্ছ বাপু?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“তা হলে আমার ওষুধে ভালই কাজ হয়েছে। কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলি। শরীরটাকে এত অবহেলা করছ কেন? তোমার বয়স তো ছাব্বিশ-সাতাশের বেশি নয়, এই বয়সে ওরকম থলথলে চেহারা কেন হবে? শরীর থলথলে হলে মানুষ ছুটতে পারে না, পরিশ্রম করতে পারে না, রোগভোগও দেখা দেয়। তুমি বোধ হয় খেলাধুলো বা ব্যায়াম করো না?”
অভয় লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে বলল, “আজ্ঞে না।”
ব্রহ্মদৈত্য বললেন, “ঠিক আছে, কয়েকদিনের মধ্যেই আমি তোমাকে শক্তপোক্ত করে দেবো। এখন আমার সঙ্গে ভেষজাগারে এসো, তোমার জন্য কয়েকটা পাতার রস করে রেখেছি। একটু তেতো লাগবে, কিন্তু মহা উপকার।”
ব্রহ্মদৈত্য অভয়কে যে ঘরটায় নিয়ে এলেন সেটা রীতিমত একটা ল্যাবরেটরি-বিশেষ। বকযন্ত্র থেকে শুরু করে বুনসেন বানার অবধি আছে। চারদিকে দেওয়ালের তাকে হরেকরকম ছোটবড় কাঁচের শিশি ও জারে নানারকম তরল পদার্থ রয়েছে। ব্রহ্মদৈত্য একটা ছোট্ট গেলাসে খানিকটা তরল জিনিস দিলেন। ঘন সবুজ রং।
অভয় সভয়ে বলে, “কী আছে এতে?”
“থানকুনি, কুলেখাড়া, কালমেঘ, পাথরকুচি আর আরও কয়েকটি পাতা। নির্ভয়ে খাও। এর পর আরও চিকিৎসা আছে।”
অভয় ওষুধ খাওয়ার পর ব্রহ্মদৈত্য তাকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে এলেন। মেঝের ওপর মাদুর আর তার ওপর শতরঞ্চি পাতা, ব্রহ্মদৈত্য বললেন, “এবার কয়েকটা যোগ আবো। গায়ের ব্যথা উবে যাবে।”
অভয় জীবনে কখনও ব্যায়াম করেনি বলে ভয় পাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু ব্ৰহ্মদৈত্য তাকে এত ধীরে-ধীরে এবং সুকৌশলে নানারকম যোগাসন করিয়ে নিলেন যে, তার তেমন কোনও কষ্ট হল না। বরং বেশ আরাম লাগতে লাগল। সবশেষে কিছুক্ষণ শবাসন করিয়ে বললেন, “যাও এবার বিশ্রাম। আধঘণ্টা পর কিছু খেয়ে নিতে হবে। পেছনদিকে কুয়ো পাবে, খুব ভাল জল, স্নান করে নাও। তোমার জন্য ধুতি আর গামছা দরদালানে রাখা আছে।”
ঘণ্টাখানেক বাদে স্নান করে দই-চিড়ে খেয়ে যখন অভয় উঠল তখন তার শরীর ঝরঝরে হয়ে গেছে। মনটাও খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে ইচ্ছে করলে সে এখন বেশ হাঁটাচলা এবং খানিকটা দৌড়ঝাঁপও করতে পারে। তারপর সে কৌতূহলী হয়ে ব্রহ্মদৈত্যকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, উঠোনে খাঁচার মধ্যে যেসব জীবজন্তু দেখছি ওদের কি আপনি পোষেন?”
“তা বলতে পারে। তবে ইচ্ছে করে পুষিনি। জঙ্গলের প্রাণীরা নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। তীর-ধনুক, বল্লম, বন্দুক দিয়ে একেবারে পশুমেধ শুরু করেছিল লোকে। আমি যে কটাকে পেরেছি বাঁচিয়েছি। রাত্রিবেলা খাঁচাতেই থাকে। একটু বেলা হলে ছেড়ে দিই। সময়মতো ওরা ফিরেও আসে।”
ব্ৰহ্মদৈত্য ঘুরে-ঘুরে তাকে জায়গাটা দেখাচ্ছিলেন। চারদিকে একটা বেশ নিবিড় লতাপাতার প্রতিরোধ আছে। ঘর বাঁশবনও রয়েছে। ব্রহ্মদৈত্য বললেন, “এটা প্রায় দুর্গের মতো জায়গা। বাইরে থেকে এ বাড়িটা দেখাও যায় না, দুম করে এসে হাজিরও হওয়া যায় না। ফলে নিরিবিলিতে ভালই থাকি। মনে হয় কোনও দেশী জমিদার বাড়ি বানিয়েছিল, তখন হয়তো বসতিও ছিল এখানে। এখন সবই হেজেমজে গেছে।”
অভয় হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, শুখানালা বলে কোনও জায়গা আছে এখানে?”
ব্ৰহ্মদৈত্য যেন একটু চমকে উঠে বললে, “শুখানালা? কেন, শুখানালা দিয়ে কী হবে?”
অভয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “কী আর হবে! ওই শুখানালায় আমাদের আদি বাড়ি ছিল। এখন নিশ্চয়ই কিছু নেই। তবে জায়গাটা একবার চোখে দেখতে পেলে ভাল লাগত।”
দুটো দীর্ঘ শক্তিমান হাত অভয়ের দু কাঁধে রেখে ব্ৰহ্মদৈত্য গম্ভীর মুখে অভয়ের দিকে চেয়ে গাঢ় স্বরে বললেন, “তোমার পদবি তো সরকার? বাই চান্স তুমি শুখানালার সরকারদের বংশধর নও তো?”
অভয় বলল, “হ্যাঁ, আমি সরকার বাড়িরই ছেলে। তবে এখানে কখনও আসিনি।”
ব্রহ্মদৈত্য বললেন, “তুমি ছাড়া বোধ হয় সরকারদের আর কোনও বংশধর নেই। শোনন, সব রহস্য তোমার কাছে খুলে বলা যাবে না। কিন্তু এই জঙ্গল ধরে যদি উত্তরদিকে যাও তবে খানিকদূর গিয়ে একটা শুকনো নালার মতো খাত পাবে। মনে হয় কোনও কালে ওটা নিকাশি খাল ছিল। ওইটে ধরে যদি এগোও তা হলে শুখানালায় পৌঁছনো কঠিন নয়। কিন্তু, সব ব্যাপারেই একটা মস্তবড় কিন্তু আছে।”