ব্রহ্মদৈত্য মাথা নেড়ে বলল, “এর অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না। খুব মারধর করেছে কেউ, গায়ে দাগড়া-দাগড়া কালশিটে। কিন্তু মুখ দেখে একে আমার খারাপ লোক মনে হচ্ছে না।”
“আমারও তাই মত।”
“তা হলে একে তুলে ডেরায় নিয়ে চল। বাঁচাতে হবে।”
কালু অত্যন্ত বলবান মানুষ। সে অভয়কে অনায়াসে তুলে একখানা চাঁদরের মতো কাঁধে ফেলে নিয়ে একটা শুড়িপথ দিয়ে এগোল। ব্রহ্মদৈত্য ফাঁকা জায়গাটার দুধারে দুটো ঝোঁপের আড়ালে রাখা দুটো স্পটলাইট নিবিয়ে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে কালুকে অনুসরণ করল।
গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি। অন্ধকার, সামনের দিকটায় বিকট ধ্বংসস্তূপ। সেটা পেরনো বেশ কষ্টকর। কারণ, পুরনো কড়ি-বরগা, বিম, থাম, রাবিশ সব
পাকার হয়ে আছে। সেটা পেরিয়ে একটু পরিচ্ছন্ন জায়গা। কয়েকটা বড়বড় খাঁচা আছে। জীবজন্তুর খাঁচা। একটা হায়েনা খাঁচার ভেতর থেকে হেসে উঠল। গরর শব্দ করে উঠল অন্য খাঁচা থেকে একটা নেকড়ে। ব্ৰহ্মদৈত্য বা কালু, কেউ অবশ্য ভূক্ষেপ করল না।
বাড়ির পেছনের দিকটা একটা আলাদা মহল। সেটার অবস্থা কিছু খারাপ নয়। অবশ্য যথেষ্ট পুরনো হয়েছে এবং মেরামতি হয়নি।
একটা ঘরে কেরোসিনের বাতি জ্বলছিল। একটা খাঁটিয়া পাতা। সেখানে এনে অভয়কে খাঁটিয়ায় শুইয়ে দিল কালু। গায়ে কম্বল চাপা দিল।
ব্রহ্মদৈত্য অভয়ের নাড়ি দেখে গম্ভীর মুখে বলল, “একটু গরম জলে অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে নিয়ে আয়। আর টেটভ্যাক, আমি চট করে পাঁচন তৈরি করে আনছি।”
নিঃশব্দে দু’জন মানুষ অভয়কে বাঁচাতে যন্ত্রের মতো কাজ করে যেতে লাগল।
ভোরের দিকে যখন ঘুম ভাঙল অভয়ের, তখন তার মনে হল, সারারাত সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। যা ঘটেছে তা সত্য নয়। কিন্তু চোখ চেয়ে ভোরের আবছা আলোয় সে যা দেখতে পেল তাও তার সত্য বলে মনে হল না। সে কি এখনও স্বপ্ন দেখছে? সে একখানা ঘরে খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে কিন্তু এরকম তো হওয়ার কথা নয়! এ ঘর তার চেনাও নয়। সে চোখ বুজে ফেলল। গায়ে এখনও অসহ্য ব্যথা, মাথা ধরে আছে। তবু অভয় উঠে বসতে পারল। খাঁটিয়া এবং গায়ে কম্বল দেখে সে আরও অবাক। এত যত্নআত্তি তার কে করল?
আগের দিনের ঘটনা ধীরে-ধীরে সবই তার মনে পড়ে গেল। সকাল থেকে সন্ধে অবধি তাকে অমানুষিক কষ্ট আর নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। দানাপানি জোটেনি, তার ওপর ওই মার? এ সত্ত্বেও যে সে বেঁচে আছে সেটাই অবাক কাণ্ড। শুধু বেঁচেই নেই, গায়ে ব্যথা-বেদনা সত্ত্বেও সে অনেকটা হালকা আর সুস্থ বোধ করছে।
অভয় গায়ের কম্বলটা সরিয়ে ধীরে-ধীরে খাঁটিয়া থেকে নেমে মেঝের ওপর দাঁড়াল। ঘরটা বেশ বড়। বহু পুরনো বাড়ি বলে দেওয়ালের চাপড়া অনেক জায়গাতেই খসে গেছে। উঁচু সিলিং। বেশ বড় বড় দুটো ভোলা জানলা দিয়ে ভোরের আবছা আলোতে বাইরের নিবিড় জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। সে কি এখনও মনসাপোঁতার জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছে? এবাড়ি এখানে এল কোত্থেকে? এখানে কারা থাকে?
কাল রাতের ব্রহ্মদৈত্যের কথা মনে পড়ায় সে একবার শিউরে উঠল।
অভয় ঘরের একমাত্র দরজাটা ভয়েভয়ে একটু ঠেলল। ভেজানো দরজা মচমচ শব্দে খুলে যায়। দরজার ওপাশে একটা বেশ লম্বা দরদালান। দরদালানে পা দিয়ে দেখতে পেল, আশপাশে আরও দু-তিনটে ঘর রয়েছে। দরদালানের দরজা খুলে বেশ বড় উঠোনের মতো দেখতে পায় অভয়। উঠোনে পাঁচ-সাতটা জীবজন্তুর খাঁচা। তাতে হিংস্র চেহারার কয়েকটি পশু রয়েছে। নেকড়ে বাঘটাকে চিনতে পারল অভয়, হায়েনাটাকে চেনা-চেনা মনে হল। বাদবাকিগুলো সম্পর্কে তার উৎসাহ রইল না। কে পোষে এগুলো? উঠোনের ওপাশে ধ্বংসস্তূপ।
অভয় একটা বিচ্ছিরি পশুর ডাক শুনতে পেয়ে চমকে দরদালানে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই কে যেন বজ্রগম্ভীর গলায় বলে উঠল, “বাঃ, এই তো আমার ওষুধে দিব্যি কাজ হয়েছে।”
মুখ ফিরিয়ে ব্রহ্মদৈত্যকে দেখেই আঁ-আঁ করে ওঠে অভয়।
ব্রহ্মদৈত্য হাসিমুখে বলে, “চেঁচিও না বাপু, ভয়ের কিছু নেই, আমি ব্ৰহ্মদৈত্য নই, মানুষ।”
অভয় এরকম দীর্ঘকায় মানুষ জীবনে দেখেনি। কত লম্বা হবে। লোকটা? সাত ফুট বা আট ফুট নয় তো!
লোকটা যেন অভয়ের মনের কথা পড়ে নিয়ে বলল, “আমার হাইট দেখছ? তা মন্দ নয়। ছ ফুট সাত ইঞ্চি। প্ল্যাটফর্ম শু
আর টপ হ্যাঁট পরলে সাত ফুটের ওপর।”
অভয় গলা-খাঁকারি দিয়ে সভয়ে বলল, “আপনি কে? আ-আমি বড় ভয় পাচ্ছি।”
“লম্বা লোককে ভয় কী?”
“আ-আপনি সত্যিকারের মানুষ তো!”
“হ্যাঁ। সত্যিকারেরই। তবে মাঝে-মাঝে ব্ৰহ্মদৈত্য সাজতে হয় আর মানুষজনকে চোরাগোপ্তা মারধরও করতে হয়। নইলে ভগবানের দান এই জঙ্গল কি বাঁচাতে পারতুম! আহাম্মক লোকগুলো গাছ কেটে আর জন্তু মেরে নিকেশ করছিল।”
“আপনি এখানেই থাকেন?”
“হ্যাঁ। এটাই আমার ডেরা বলতে পারো।”
“আপনি কি বাঙালি?”
লোকটা সবেগে মাথা নেড়ে বলে, “না হে বাপু। গায়ের রং দেখছ না? আমি ঘোর ইউরোপিয়ান। সুইডেনে বাড়ি। ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার আকর্ষণে চলে এসেছিলাম বছর দশেকআগে। সেই থেকে রয়ে গেছি।”
“আপনি কি সাধু?”
“সাধু হতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে বাপু, ভণ্ড নই। যা করার তা প্রাণপণ করি। একশো পারসেন্ট। তোমার দেশের লোকগুলো বড় লোভী। আহাম্মক আর অদূরদর্শী। বন-জঙ্গল, গাছপালার প্রতি কোনও মায়া নেই। যখন-তখন ইচ্ছেমতো গাছ কেটে চারদিক ন্যাড়া করে দেয়। পশুপাখিও মারে নির্বিচারে। সেইটে বন্ধ করতে পেরেছি বলে আজ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।”