অভয় ঘাড় নাড়ল।
রেমো শব্দ করে একটা হাই তুলল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, “ও অক্ষয়, মকর নন্দীর জমিটা কি কিনছো নাকি? মকর একটা খবর পাঠিয়েছে। বলব?”
অক্ষয় ভাতভর্তি মুখেই উঁচু গলায় বলল, “বলবে না মানে! কতকাল ধরে জমিটার ওপর নজর আমার! এসো এসো, খবরটা বলে যাও।”
“যাব তো, কিন্তু ডাকাতটা আবার এই ফাঁকে পালাবে না তো?”
“আরে না। ওর হাড়গোড় কি আর আস্ত রেখেছি নাকি, তার ওপর আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। পালাবে না। তুমি এসে খবরটা বলল।”
“যাই।” বলে যেন অনিচ্ছের সঙ্গেই রেমো উঠে গেল। চাপা গলায় বলে গেল, “এই সুযোগ কিন্তু আর আসবে না।”
সুযোগ বলতে সুযোগ! একেবারে সুবর্ণ সুযোগ। হ্যাঁচকা টান মারলেই বাঁধন খুলে যাবে। কিন্তু হ্যাঁচকা মারবার ক্ষমতাটুকুও যে অভয়ের নেই। তার আদরের শরীরের ওপর দিয়ে আজ যা ঝড় গেল!
বার কয়েক হ্যাঁচকা মারার চেষ্টা করে দেখল অভয়। হচ্ছে না। বরং সেই পরিশ্রমে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু বাঁচতেও তো হবে! হাতে বেশি সময় নেই। দূরে যেন লোকজনের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। কারা আসছে বুঝি!
অভয় প্রাণ হাতে করে শরীরে একটা মোচড় দিল। তারপর দুটো।
তিনবারের বার বাঁধন খুলে সে হড়াস করে পড়ে গেল বারান্দা থেকে উঠোনে। পড়ার ধাক্কাটা সামলে সে আর দাঁড়ানোর চেষ্টা করল না। হামাগুড়ি দিয়ে কচুবনের দিকে এগোতে লাগল।
চার-পাঁচজন লোক হল্লা করতে করতে উঠোনে ঢুকে পড়েছে। মুখ ফিরিয়ে দৃশ্যটা দেখেই অভয়ের শরীরে যেন দূননা বল এল।
প্রবল বেগে হামা দিতে দিতে সে কচুবনে ঢুকে পড়ল, তারপর উঠে দাঁড়াল। রেমো পথের কথা বলেছিল, কোথায় পথ? সামনে বুকমান আগাছা আর অন্ধকার। পথ নয় বটে, তবে বিপদে পড়লে সব আঘাটাই পথ।
অভয় কাঁদছিল, জীবনে এত হেনস্থা, অপমান আর লাঞ্ছনা তাকে কেউ কখনও করেনি। এত মারধর জীবনে খায়নি। এত পরিশ্রমও জীবনে করতে হয়নি। নিজের জন্য আজ তার বড় কষ্ট হচ্ছে। বেঁচে থাকায় আর কী লাভ?
তবু জৈব তাগিদে সে চলতে লাগল। শীত, কুয়াশা, অন্ধকার, জঙ্গল, তবু চোখের জল মুছতে মুছতে অভয় এগোচ্ছে। দৌড়নোর মতো অবস্থা তার নয়। একটু পেছনে দূরে চেঁচামেচি আর ছোটাছুটির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকগুলো মশাল জ্বলে উঠে আগাছার জঙ্গলেও আলোর আভা এনে ফেলল। কিছু মানুষ যে তার খোঁজে পিছু নিয়ে আসছে তাও টের পেল অভয়। কিন্তু তবু তাড়াহুড়ো করল না। যা হওয়ার হবে। মরবে? তা না হয় মেরেই ফেলুক। এর চেয়ে মরাটা আর এমনকী বেশি?
ক্রমে-ক্রমে চারদিকে উঁচু-উঁচু গাছ দেখা দিতে লাগল। অন্ধকার আরও ঘন হতে লাগল। পেছনের কোলাহল থেমে গিয়ে চারদিক ভীষণ নির্জন হয়ে গেল। অভয় বুঝতে পারল যে, আবার মনসাপোঁতার জঙ্গলে ফিরে এসেছে। সভয়ে দাঁড়িয়ে সে চারদিকটা দেখল। অন্ধকার ছাড়া অবশ্য দেখার কিছু নেই। আর কুয়াশাও বড্ড ঘন। নিজের হাতখানা পর্যন্ত ঠাহর হয় না। রাতচরা একটা পাখি টি-হিট করে ডেকে উঠল। শেয়ালের ঝাঁক হাসল তাদের অট্টহাসি। একটা বুনো জানোয়ার খ্যাখ্যা করে যেন
অভয়কেই ভ্যাঙাল।
অভয় সামনের দিকে পা বাড়াতেই চমকে উঠে শুনল, তার
পেছনে যেন কেউ হাই করে একটা শ্বাস ছাড়ল।
“কে?” কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে অভয়।
কেউ জবাব দেয় না। কিন্তু অভয় আবার এগোতেই পেছনে আবার হাই-হাই-হাই শব্দ হতে লাগল। অভয় চলা ছেড়ে ছুটতে লাগল। পেছনে হাই-হাই শব্দটাও সমান বেগে তেড়ে আসছে। গাছপালা ক্রমে ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে, ঝোঁপঝাড় লতাপাতায় পথ এত দুর্গম যে, এগনো যাচ্ছে না। অভয় বারবার আছাড় খাচ্ছে, কিন্তু ঝোঁপঝাড়ের ওপর পড়ায় তেমন ব্যথা পেল না। তবে দুবার দুটো গাছের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ হল তার। তাতে ব্যথা পেলেও তার শরীরে ইতিমধ্যেই এত ব্যথা জমা হয়েছে যে, তার তুলনায় এব্যথা নস্যি।
একটা ঘন ঝোঁপ পেরিয়ে হঠাৎ সামনে আলো দেখতে পেল অভয়। তেমন জোরালো আলো নয়। ভারী মোলায়েম মিঠে নীলচে একটা আভা। পেছনে হাই-হাই শব্দটা থেমেছে।
বিপদ কি তা হলে কাটল? সামনে কি কারও বাড়ি-টাড়ি আছে?
একটু বাদেই ভুল ভাঙল। বাড়ি নয়, সামনে একটু ফাঁকা গোল জায়গা। সেখানে কোথা থেকে যেন নীলচে একটা আলো এসে পড়েছে।
তারপর অভয় যা দেখতে পেল তাতে গায়ের রক্ত জল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ফাঁকা জায়গাটায় একটা অস্বাভাবিক লম্বা লোক দাঁড়িয়ে আছে। খালি গা, গলায় পৈতে, সাদা ধবধবে লোকটার গায়ের রং। মাথায় জটা রয়েছে। পরনে শুধুমাত্র একটা লেংটি। হাতে একটা মুগুরের মতো জিনিস। ব্রহ্মদৈত্য!
লোকটা যেন অভয়ের জন্যই অপেক্ষা করছিল। নীলচে আলোয় একজোড়া কুদ্ধ চোখ যেন নীল আলোয় ছ্যাঁদা করে দিল অভয়কে।
লোকটা মুগুর তুলে অভয়ের দিকে এগিয়ে আসতেই অভয় দুহাত ওপরে তুলে “বাবা গো! মেরে ফেললে!” বলে চেঁচিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
ব্রহ্মদৈত্য তার মুগুরটা নামিয়ে অভয়ের কাছে এসে নিচু হয়ে মুখটা দেখল। তারপর জঙ্গলের দিকে চেয়ে বজ্রগম্ভীর স্বরে হাঁক দিল, “কালু, এদিকে আয়।”
জঙ্গল কুঁড়ে একটা কালোমতো মজবুত চেহারার লোক বেরিয়ে এল, হাতে টর্চ।
ব্ৰহ্মদৈত্য বলল, “একে চিনিস? ভাল করে মুখটা দেখ দিকি।”
কালু টর্চ জ্বেলে মুখটা দেখে নিয়ে বলল, “আজ্ঞে না। এদিককার লোক নয়। কোথা থেকে এসে পড়েছে।”