কবরেজমশাই বৈঠকখানায় বসে কী একটা ঘষছিলেন। সবসময়েই তিনি কিছু না-কিছু বানিয়েই যাচ্ছেন। লতাপাতা, শেকড়বাকড়, ধাতু, পাথর, মধু, দুধ– এই সব সারাদিন একটার সঙ্গে আর-একটা মেশাচ্ছেন, জ্বাল দিচ্ছেন, পোড়াচ্ছেন। এরকম কাজপাগল লোক গৌর দুটো দেখেনি। ৩০
তাকে দেখে কবরেজমশাই হাতের কাজ থামিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “এ, তোর গা থেকে যে বড্ড ভূত-ভূত গন্ধ আসছে রে। ওই বুজরুক ফকরেটার কাছে গিয়েছিলি নাকি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।”
“আবার সমস্যা কীসের?”
“আমার একটা জিনিস হারিয়েছে।”
“অ। তাই ফকরেটার কাছে গিয়েছিলি বুঝি? তা কী বলল বুজরুকটা?”
“আজ্ঞে সে মেলা কথা।”
“তা জিনিসটা পাওয়া গেল না তো!”
“আজ্ঞে না। যোগেশ্বরবাবার দেওয়া সেই কবচ নাকি ফকিরসাহেবের আরশিতে দেখা দেন না।”
কবিরাজমশাই এতক্ষণ দিব্যি সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন। কবচের কথা শুনে আচমকা একটা ‘আঁক করে শব্দ তুললেন গলায়। তারপর বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন গৌরের দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে গৌরের মনে হল, কবিরাজমশাই বুঝি বসে বসেই মূৰ্ছা গেছেন। ভয় খেয়ে সে কবিরাজমশাইয়ের গায়ে একখানা ঠেলা দিয়ে ডাকল, “কবরেজমশাই! ও কবরেজমশাই!”
কবিরাজমশাই চোখ পিটপিট করে খুব নিচু স্বরে বললেন, “সর্বনাশ!”
“ফকিরসাহেবও সেই কথাই বলছিলেন। কবচটা হারানো নাকি ঠিক হয়নি। কুলুঙ্গিতে পটের পিছনে কবচটা লুকোনো ছিল। হারানোর কথা নয়। তবু যে কী করে হারাল!”
কবিরাজমশাই খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “কুলুঙ্গি! তোর কি মাথা খারাপ? ও জিনিস কেউ হেলাফেলা করে এখানে-সেখানে ফেলে রাখে?”
গৌর কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে, “এখন তা হলে কী হবে কবরেজমশাই?”
কবিরাজমশাই মুখ ভেঙিয়ে বলে উঠলেন, “কী হবে কবরেজমশাই! কী হবে তার আমি কী জানি রে লক্ষ্মীছাড়া? বেরো, বেরো, দুর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে! হাঁদারাম কোথাকার!”
গৌর ভয় খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। তারপর চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরে এল বাড়ি। বাড়িতে ঢুকতেই দেখল, বড় ঘরের বারান্দায় হ্যারিকেনের আলোয় তার দাদা নিতাই দুই শালাকে নিয়ে খেতে বসেছে। গরম ভাত আর ডালের গন্ধে ম ম করছে বাড়ি।
৩. গৌর নিজের অন্ধকার ঘরখানায় ঢুকে
গৌর নিজের অন্ধকার ঘরখানায় ঢুকে একপেট জল খেয়ে বসে রইল। নিতাই আর তার দুই শালা আঁচিয়ে ঘরে ঢুকল। বউদি এঁটো সারছে। আজ আর তাকে কেউ খেতে ডাকল না। শুধু নিতাই নিজের ঘর থেকে একখানা হাঁক দিয়ে বলল, “গৌর, জেগে আছিস তো?” ||
গৌর ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “আছি।”
“এবার তা হলে রোদে বেরিয়ে পড়। আমরা ঘুমোচ্ছি।”
গৌর কী আর করে। লাঠিগাছ হাতে নিয়ে বেরোল। ঠিক নিতাই যেমন বলেছিল, তেমনি লাঠি ঠুকে ঠুকে চারদিক ঘুরে ঘুরে পাহারা দিতে লাগল।
তারপর শেয়াল ডাকল, প্যাচা ডাকল, ঝিঝি ঝিনঝিন করতে লাগল। ক্রমে রাত নিশুত হয়ে গেল। গৌরের পেট খাঁখাঁ করতে লাগল খিদের চোটে। বড় ঘরের দাওয়ায় একটু জিরোতে বসল সে। তারপর কখন একটু ঢুলুনি এসে গেল।
আচমকা চটকা ভেঙে উঠে বসল সে। কীসের একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনেছে সে ঘুমের মধ্যে। অনেকটা দরজার শেকলের শব্দের মতো। লাঠি হাতে গৌর উঠে আর-একবার বাড়িটা একপাক ঘুরে দেখল। দরজা-জানালা সব ঠেলেঠুলে দেখল, সবই বন্ধ আছে। নিশ্চিন্ত হয়ে আবার সে দাওয়ায় বসে একটা হাই তুলল। গোবিন্দদা বলেছিল আসবে। এল না কেন তা বোঝা যাচ্ছে না।
ফের দুলুনি আসতে না আসতেই আবার শব্দ। শেকল নাড়ার শব্দ নয়, এবার বেশ মনে হল ধারেকাছে কেউ ফিসফাস করে কথা বলছে। গৌরের গায়ে একটু কাঁটা দিল। ভয়-ভয় করতে লাগল। আর-একবার লাঠি ঠুকে বাড়িটা চক্কর দিল সে। কোথাও কিছু নেই।
এবার গৌর দাওয়ায় একটু গা এলিয়ে দিয়ে বসল, শরীরটা ঝিমঝিম করছে খিদে আর ক্লান্তিতে। হাঁটাহাঁটি ভাল লাগছে না। ঢুলতে ঢুলতে গৌর কখন হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা আর খেয়াল নেই।
খাউ আর মাউ যে ঘরটায় থাকে, সেটা এ বাড়ির সেরা ঘর। তবে পুরনো বাড়ি বলে জানালা-দরজা খুলতে বা বন্ধ করতে প্রচণ্ড কাঁচকোঁচ শব্দ হয়। আচমকা সেই শব্দ গৌরের ঘুমের মধ্যেও সেঁধোল গিয়ে। চটকা ভেঙে সে উঠে বসল। তারপরই দেখল, খাউ আর মাউয়ের ঘরের দরজা খুলে সেই লম্বা লোকটা বেরিয়ে আসছে। লোকটার পরনে একটা আলখাল্লার মতো লম্বা ঝুলের পোশাক। কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে লোকটা লম্বা লম্বা পা ফেলে উঠোনে নেমে চলে যাচ্ছিল।
গৌর কী করবে প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। হাতের লাঠিটার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে তাই সে হঠাৎ চিৎকার করার জন্য হাঁ করল।
কিন্তু সেই সুযোগ আর পেল না। পিছন দিক থেকে একটা হাত এসে তার মুখ খুব শক্ত করে চেপে ধরল। প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়ে আঁট হয়ে বসা হাতটার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে জুত করতে পারল না গৌর। একে উপোসি শরীর, তার ওপর রাত জাগার ক্লান্তি। তবে বুদ্ধি করে সে ফুট করে একটা কামড় বসাল হাতটায়।
পিছন থেকে “উঃ” শব্দ শোনা গেল। তারপরই হাতটা সরে গেল মুখ থেকে। গোবিন্দ হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “আর-একটু হলেই কাঁদিয়ে দিয়েছিলি আর কী।”
“ওঃ, গোবিন্দদা! তুমি কখন এলে?”
“এসেছি অনেকক্ষণ, তোর দাদা ঘুমোতে যাওয়ার আগে।”