“আজ্ঞে, গোরুটোরু চরাই, বাসন-টাসন মাজি, কাঠটাঠ কাটি, কখন কোথায় ছিটকে পড়ে যায়, সেই ভয়ে হাতে পরিনি।”
ফকিরসাহেব দু’খানা হাত গৌরের মুখের সামনে নাচিয়ে বললেন, “উদ্ধার করেছ। এখন কী সর্বনাশ হয় দেখো।”
এই বলে গম্ভীর মুখে ফকিরসাহেব উঠে গিয়ে বারান্দার এক কোণে তামাক সাজতে বসলেন।
গৌর ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারল না। তবে কাঁচুমাচু মুখ করে বসে রইল চুপচাপ।
ফকিরসাহেব অনেকক্ষণ ধরে তামাক খেলেন। তারপর কলকে উপুড় করে রেখে নিমীলিত চোখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বললেন, “ও কবচের কথা এ-গাঁয়ে মাত্র কয়েকজন জানে। এই ধর আমি, কবিরাজ, সুবল হোমিও, চোর গোবিন্দ, এমন ক’জন মাত্র। যারা জানে, তাদের বয়স এই আমারই মতো দেড়শো বা দুশো বছর।”
গৌর চোখ কপালে তুলে বলে, “গোবিন্দদার বয়স দেড়শো-দুশো?”
“এই সবে একশো একান্ন হয়েছে। আমার চেয়ে বাহান্ন বছরের ছোট। কবিরাজের বোধহয় একশো পঁচাত্তর চলছে, সেদিনের ছোঁকরা। সুবলের গত মাঘে দুশো হয়ে গেল।”
গৌর খুব ভক্তিভরে চেয়ে ছিল। বলল, “উরে বাবাঃ।”
“বয়সের কথাটা তুললাম কেন জানিস? তোদের ওই কবচটার ইতিহাস পুরনো লোক ছাড়া কেউ জানে না। আর ইতিহাসও সাংঘাতিক। তিনশো বছর আগে এই গাঁয়ে যোগেশ্বর নামে একজন লোক থাকতেন। সে কীরকম লোক তা এককথায় বলা মুশকিল। তবে আমরা তাঁকে আকাশে উড়তে, জলের ওপর হাঁটতে আর ডাঙায় ডিগবাজি খেয়ে খেয়ে চাকার মতো চলেফিরে বেড়াতে দেখেছি। তিনি আগুন দিয়ে বরফ জমাতে পারতেন, দিনদুপুরে অমাবস্যার অন্ধকার নামাতে পারতেন, একমুঠো ধুলো নিয়ে এক ফুঁ দিয়ে সোনার গুঁড়ো তৈরি করতেন। আমি, কবরেজ, গোবিন্দ, সুবল সব তার শাগরেদি করতুম। এই যে আরশিখানা দেখছিস, এ তাঁরই দেওয়া। কবরেজটা তেমন কিছু শিখতে পারল না বলে ওকে কবরেজির লাইনে ঠেলে দিয়েছিলেন তিনি। একখানা শিশিও দিয়েছিলেন ওকে, তাতে কী আছে জানি না। গোবিন্দ, সুবল, ওরাও কিছু না-কিছু পেয়েছিল, তবে ও-সব গুহ্য কথা। তোর ঠাকুরদার ঠাকুরদাও ছিল তাঁর শাগরেদ। সে পেয়েছিল ওই কবচখানা। যাকে বলে জ্যান্ত কবচ। কবচের গুণাগুণ বলা বারণ, অত ভেঙে বলেনওনি যোগেশ্বরবাবা। তবে আমার ধারণা, ওই কবচ ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে মানুষের অসাধ্যি কিছু নেই। কিন্তু বংশের বাইরে কারও হাতে গেলেই সর্বনাশ।”
গল্প শুনে গৌর আর-একটু এগিয়ে বসল। বলল, “আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদাকে আপনি চিনতেন?”
“চিনব না মানে? এইটুকু দেখেছি।”
“তা যোগেশ্বরবাবার দয়ায় আপনারা সব এতকাল ধরে বেঁচে আছেন, তবে তিনি মরলেন কেন?”
“মরেছে! তোকে কে বলল যে, মরেছে! যোগেশ্বরবাবার যখন হাজার বছর বয়স পুরল তখন আমাদের ডেকে একদিন বললেন, “ওরে আমার তো মরণ নেই, কিন্তু এই শরীরটা বড় পুরনো হয়ে গেছে। হাড়গুলোয় ঘুণ ধরেছে, চামড়াটাও বড্ড কালচে মেরে গেছে, মাংস যেন ছিবড়ে। তা এটাতে বাস করতে আর আমার মন চায় না। আজই এটা ছেড়ে ফেলব। আমরা শুনে তাঁর হাতে-পায়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলুম। তখন তিনি বললেন, “মন যখন করেছি তখন ছাড়বই। ছেঁড়া, ময়লা, নোংরা জামা গায়ে পরে থাকতে যেমন ঘেন্না হয়, আমারও এই শরীরটা নিয়ে তাই হয়েছে। তবে তোরা দুঃখ করিস না, শরীর ছাড়লেও আমি কাছাকাছিই থাকব।’ এই বলে তিনি পটাং করে শরীরটা ফেলে দিলেন। বাস্তবিকই শরীরটায় আর কিছু ছিল না, একেবারে চামচিকের মতো দেখতে হয়েছিল। আমরা সবাই খুব কান্নাকাটি করলুম। কিন্তু তোর ঠাকুরদার ঠাকুরদা ফটিক শোকে কেমন হয়ে গেল। যোগেশ্বরবাবার সেই শরীরখানা ঘাড়ে নিয়ে বিবাগি হয়ে গেল। সে মরেনি, দিব্যি আছে। আরশিখানার ভিতর দিয়ে তার সঙ্গে প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হয়, হিমালয়ে এক দুর্গম জায়গায় খুব জপতপ করছে ব্যাটা। এই আরশিখানা দিয়ে সব দেখা যায় কিনা।”
“তা হলে আমার কবচখানা কোথায় তা একটু দেখে দিন।”
ফকিরসাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “ওটি হওয়ার জো নেই। এই আরশি দিয়ে আর সব দেখা গেলেও যোগেশ্বরবাবার মন্ত্রপূত জিনিস কোনওটাই দেখার উপায় নেই। এই ধর যেমন কবরেজের শিশি, ফটিকের কবচ, সুবল বা গোবিন্দর কাছে যা আছে সে-সব এই আরশিতে ধরা পড়বে না। তাই বলছি, কবচটা হারিয়ে খুব গ্যাড়াকলে পড়ে গেছিস। এখন খুঁজেপেতে দেখগে কে নিল।”
ফকিরসাহেবের গল্প শুনে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল গৌর। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে যায় না, আবার না করেই বা উপায় কী। বাড়ি ফিরে গৌর একভাই বাসন মাজল, উঠোন ঝাঁট দিল, গাছে জল দিল, গোরুকে জাবনা দিল। তারপর মাটি কোপাতে গেল বাড়ির উত্তর দিককার বাগানে। কবচখানার জন্য মনটা বড় খারাপ। মন খারাপ থাকলে গৌরের গায়ে বেশ জোর আসে, কাজও করে ফেলে চটপট। যে মাটি কোপাতে অন্য দিন সন্ধে হয়ে যায়, তা আজ গৌর এক লহমায় কুপিয়ে ফেলল।
গৌর কুয়োর পাড়ে যখন মাটিমাখা হাত-পা ধুচ্ছে, তখন নেতাইগোপাল এসে বলল, “মনে আছে তো?”
গৌর ঘাড় নেড়ে বলে, “আছে।”
“আজ রাত থেকে তোর খাওয়া বন্ধ। সারারাত ঘরদোর পাহারা দিবি। বসে বসে আবার ঢুলিস না যেন। সবসময়ে পায়চারি করবি আর মাঝে মাঝে লাঠি ঠুকবি। মনে থাকবে যা বললুম?”
গৌড় ঘাড় নেড়ে বলল, “থাকবে।”
সন্ধের পর গৌর চুপিসারে বেরিয়ে পড়ল কবরেজমশাইয়ের বাড়ির দিকে। পথেই বাজারের গা ঘেঁষে হরিপদর ফুলুরির দোকান। দারুণ করে। দেখল, সেখানে দাঁড়িয়ে মাউ আর খাউ খুব মনের সুখে ফুলুরি ওড়াচ্ছে। গৌর আড়াল হয়ে সুট করে কেটে পড়ল।