গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “সেকথা পরে হবে। আগে ভাল করে লোকটার চেহারাটা মনে করে বল।”
“খুব ভাল করে দেখিনি। জ্যোৎস্নার আলোয় আবছা-আবছা যা মনে হল, লোকটা তালগাছের মতো ঢ্যাঙা, রোগাটে চেহারা, লম্বা লম্বা পা ফেলে উঠোন পেরিয়ে চলে গেল। তারপর খাউ আর মাউয়ের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পেলাম।”
গোবিন্দ দড়ি পাকানো বন্ধ করে গোল-গোল চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, “ঢ্যাঙা লোক বললি? খুব রোগা?”
“সেরকমই মনে হল।”
গোবিন্দ দু-একটা শ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, “এ অঞ্চলের লোক হলে ঠিক বুঝতে পারতাম লোকটা কে। না রে, এ তল্লাটের লোক নয়। চোর বলেও মনে হচ্ছে না। চোর হলে দরজায় শব্দ হত না। তোর দাদার ওই দুই গুন্ডা শালার স্যাঙাত নয় তো?”
“তাও হতে পারে।”
“একটু নজর রেখে চলিস। ওদের বড়ভাইটা তোক ভাল নয়। সেটা এখন জেলখানায় আছে বটে, কিন্তু চারদিকে তার অনেক চ্যালা-চামুণ্ডা।”
“হাউয়ের কথা বলছ? তাকে চেনো নাকি?”
“খুব চিনি, হাড়ে হাড়ে চিনি। বিশাল লম্বাচওড়া চেহারা, গায়ে অসুরের মতো জোর। সেই জোর নিয়ে কী করবে তা ভেবে পায়। তাই সবসময়ে একে মারছে, তাকে ধরছে, লোকের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছে। চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করে খুন অবধি কিছু বাকি নেই। হেন কাজ নেই যা ও করতে পারে না।”
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “শুনছি জেল থেকে বেরিয়ে সেও এখানে আসছে।”
“আমিও শুনেছি। তোর দাদার মাথায় গোলমাল আছে বলেই শালাকে আদর করে এনে বসাতে চাইছে। কিন্তু এই আমি বলে দিচ্ছি, হাউ যদি আসে তবে তোদের কাউকে আর ওই ভিটেয় তিষ্ঠোতে হবে না। এমনকী, গায়ে লোক থাকতে পারবে কি না সন্দেহ।”
গৌর হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। গোবিন্দ তার দিকে চেয়ে বলল, “লম্বা লোকটা কে সেটা আমাকেও জানতে হচ্ছে। তুই ভাবিস না, আজ রাতে তোর সঙ্গে আমিও পাহারা দেব’খন।”
খানিকটা ভরসা পেয়ে গৌর উঠে গোরু চরাতে গেল। গোরু চরাতে গৌরকে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয়, তা নয়। গোরুগুলো আপনি ঘুরে ঘুরে মাঠের নধর ঘাস খেয়ে বেড়ায়। গৌর শুধু নজর রাখে যাতে ওরা হারিয়ে না যায় বা কারও বাগানে বা বাড়িতে না ঢোকে, কিংবা নালানর্দমায় না পড়ে-উড়ে যায়। গোর মাঠে ছেড়ে দিয়ে গৌর প্রথমে জঙ্গলে গিয়ে ঢোকে। দুপুরবেলাটায় তার বড় খিদে পায়। কিন্তু এত ঘনঘন খিদে পেলে তো চলবে না। দুপুরের ভাত সেই বেলা গড়ালে গিয়ে জুটবে। ততক্ষণে গৌর জঙ্গলে ঢুকে ফলটল খোঁজে। পেয়েও যায় মাঝে মাঝে। এক-এক সময়ের এক-এক ফল। কখনও কামরাঙা, কখনও আতা, তেঁতুল, বেল, মাদার বা ফলসা। চুনোকুল আর বনকরমচাও মিলে যায় কখনও কখনও। তারপর একটা ঝুপসি গাছের তলায় শুয়ে সে কিছুক্ষণ ঘুমোয়।
আজ গৌর জঙ্গলে দুটো আতা পেয়ে গেল। ভারী মিষ্টি। খেয়ে গাছতলায় গামছা পেতে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গৌর স্বপ্ন দেখল, মা তার মাথার কাছটিতে এসে বসেছে। খুব মিষ্টি করে মা বলল, “কবচটা পরিসনি? ওরে বোকা! কবচটা সবসময়ে পরে থাকবি।”
ঘুম ভেঙে গৌর ধড়মড় করে উঠে বসল। তাই তো! কবচটার কথা যে তার খেয়ালই ছিল না। ঘরে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা আছে।
দুপুরবেলা বাড়ি ফিরেই গৌর গিয়ে কুলুঙ্গিতে কবচটা খুঁজল। নেই। গৌর অবাক। কাল রাতে নিজের হাতে কবচটা এইখানে রেখেছে সে। গেল কোথায়? সারা ঘর এবং ঘরের আশপাশে আঁতিপাঁতি করে খুঁজল সে। কোথাও কবচটা খুঁজে পেল না। বুকটা ভারী দমে গেল তার। চোখে জল এল। কবচটার মধ্যে যে বিশেষ কোনও গুণ আছে, তেমন তার মনে হয় না। তবে মায়ের দেওয়া জিনিসটার মধ্যে মায়ের একটু ভালবাসা আর আশীর্বাদও তো আছে।
ঢাকা ভাত রান্নাঘরে পড়ে ছিল। গৌর স্নান সেরে কড়কড়ে সেই ঠান্ডা ভাত একটু ডাল আর ডাঁটাচচ্চড়ি দিয়ে কোনওক্রমে গিলেই ফকিরসাহেবের কাছে দৌড়োল, লোকে বলে ফকিরসাহেব তাঁর আরশিখানার ভিতর দিয়ে তামাম দুনিয়ার সব জিনিস দেখতে পান। হারানো জিনিসের সন্ধান তাঁর মতো আর কেউ দিতে পারে না।
ফকিরসাহেব এই দুপুরেও আরশিখানা হাতে নিয়ে দাওয়ায় বসে ছিলেন। চোখ দুটো টুলটুলু, মুখে পান।
“ফকিরসাহেব! ও ফকিরসাহেব!”
ফকিরসাহেব একটু চমকে উঠে বললেন, “কে রে! গৌর!”
“আমার একটা জিনিস হারিয়েছে ফকিরবাবা।”
ফকিরসাহেব একটা হাই তুলে তুড়ি দিয়ে বললেন, “হারিয়েছে চুরি গেছে? ঘর থেকে না বার থেকে? ধাতুদ্ৰব্য না অধাতুদ্ৰব্য? ভারী না হালকা? চকচকে না ম্যাটমেটে?”
“একটা কবচ ফকিরবাবা। একটা তামার কবচ। আমার মা মরার আগে দিয়ে গিয়েছিল।”
কথাটা শুনে ফকিরসাহেব কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইলেন। সেই হাঁ দেখে গৌরের মনে হয়েছিল, ফকিরসাহেব বুঝি আবার হাই
তুলছেন। কিন্তু এতক্ষণ ধরে কেউ তো হাই তোলে না! আর হাই তোলার সময়ে কেউ ওভাবে গুলু-গুলু চোখ করে চেয়েও থাকে না। গৌরের বেশ ভয়-ভয় করতে লাগল। ফকিরসাহেব হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “হারিয়ে বসলি? মুখ গাধা কোথাকার!”
গৌর হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “আমার দোষ নেই। কুলুঙ্গিতে যত্ন করে রেখেছিলুম।”
ফকিরসাহেব মুখ ভেঙিয়ে বললেন, “কুলুঙ্গিতে রেখেছিলুম! মাথাটা কিনে নিয়েছিলে আর কী! কেন রে হতভাগা, কবচটা হাতে পরে থাকতে কী হয়েছিল?”