গৌর এ-রকম ঢ্যাঙা লোক এ অঞ্চলে আর দেখেনি। লোকটা চলে যেতেই খাউ আর মাউয়ের ঘরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
এই নিশুতি রাতে এরকম একটা অদ্ভুত লোক ওদের ঘরে এসেছিলই বা কেন আর চুপিচুপি চলেই বা গেল কেন, তা ভেবে পেল না গৌর। ভাববার মতো শরীরের অবস্থাও নয় তার। খিদের চোটে পেট থেকে গলা অবধি তার আগুন জ্বলছে।
ঘরে এসে সে ঘুমোবার চেষ্টা করল। না, ঘুম আসছে না। উঠে একটু পায়চারি করল। তাতেও হল না। তখন সে খুব কষে কয়েকটা বুকডন আর বৈঠক দিয়ে নিল। তাতে হল হিতে বিপরীত। খিদেটা রাক্ষসের মতো হাঁউ-মাউ-খাউ করে তার পেটটাকে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল।
গৌর কুলুঙ্গিতে পটের পিছনে লুকোনো কবচটা বের করে হাতের মুঠোয় ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “মা, তুমি বেঁচে থাকতে কখনও খাওয়ার কষ্টটা হয়নি। এবার যে খিদেয় বাঁচি না। বাঁচিয়ে দাও মা।” খিদেটা তাতে মরল না বটে, কিন্তু কবচটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে থাকতে থাকতেই গৌর কাহিল হয়ে শুয়ে পড়ল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তা আর তার খেয়াল নেই।
২. পেটে ভাত নেই বলে
পেটে ভাত নেই বলে গৌরের ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। শরীরটা বেশ কাহিল লাগছিল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বাইরে এসে গৌর অভ্যাসবশে গিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকল।
গোরুদের সঙ্গে গৌরের ভারী ভাবসাব। তাদের দুটো গোরু, দুটো বাছুর। গৌরকে দেখলেই তারা ভারী চঞ্চল হয়ে ওঠে। গা শুকে, চেটে, কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নানারকমভাবে তাদের আদর জানায়। পশুপাখিরাও মানুষ চেনে। গৌর গোরুদের গায়ে হাত বুলিয়ে, গলকম্বলে সুড়সুড়ি দিয়ে আদর করে বলল, “বড্ড খিদে পেয়ে গেছে তোদের, না রে? চল, আগে তোদের জাবনা দিই।” বড় গোরুটা এই কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
গোরুদের জাবনা দিতে দিতে গৌরের সেই লম্বা নোকটার কথা মনে পড়ল। মাউ আর খাউয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে লোকটা হনহন করে কোথায় যেন চলে গেল। চোর-ডাকাত নয় তো! কথাটা একবার তার দাদা নিতাইয়ের কানে তোলা দরকার। গাঁয়ের চোরদের সবাইকেই চেনে গৌর। তাদের সঙ্গে বেশ ভাবসাবও আছে। সুতরাং লোকটা গাঁয়ের আশপাশের গায়েরও নয়। তা হলে লোকটা কে?
নিতাই যখন পুকুরের ঘাটলায় দাঁড়িয়ে দাঁতন করছিল, তখন গৌর গিয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “দাদা, একটা কথা ছিল।”
নিতাই ভাইয়ের ওপর বিশেষ সন্তুষ্ট নয়। অন্য দিকে চেয়ে বলল, “পয়সা-টয়সা চেয়ো না। অন্য কথা থাকলে বলতে পারো।”
“না, পয়সা নয়। আমি পয়সা দিয়ে কী করব! বলছিলাম কী, কাল রাতে বাড়িতে চোর এসেছিল।”
নিতাই আঁতকে উঠে বলে, “চোর! কোন চোর দেখেছিস?”
“চেনা চোর নয়। লোকটা খুব লম্বা, খাউ আর মাউয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল দেখলাম।”
“তা হলে চেঁচাসনি কেন?”
“আমার প্রথমটায় মনে হয়েছিল, বোধহয় ওদের চেনা লোক। দরজা খুলে বেরোল, তারপর আবার ভিতর থেকে কে যেন দরজা বন্ধ করে দিল। তাই বুঝতে পারছিলাম না কী করব। যদি কুটুমদের চেনা লোক হয়, তা হলে চোর বলে চেঁচালে তাদের অপমান হবে।”
নিতাই দাঁতন করা থামিয়ে গৌরের দিকে চেয়েছিল। হঠাৎ বলল, “কীরকম চেহারাটা বললি?”
“খুব লম্বা আর সুভুঙ্গে।”
নিতাই গম্ভীর হয়ে বলল, “আজ রাত থেকে তোর ঘুমোনো বন্ধ। সারারাত জেগে লাঠি নিয়ে বাড়ি পাহারা দিবি। তোর বউদিকে বলে দিচ্ছি, আজ থেকে যেন তোকে রাতে ভাতটাত না দেয়। ভাতটাত খেলেই ঘুম আসে। পেটে একটু খিদে থাকলে জেগে থাকতে সুবিধে হয়।”
নিতাইয়ের কথা শুনে গৌরের মুখ শুকিয়ে গেল। একেই তো বউদি তাকে পেটভরে খেতে দেয় না বলে সারাদিন পেটের মধ্যে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে। তার ওপর রাতের খাওয়া বন্ধ হলে যে কী অবস্থা হবে! কিন্তু কী আর করা। গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাট্টি পান্তাভাত খেয়ে গোরু নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
নদীর ধারের মাঠে গোরুগুলিকে ছেড়ে দিয়ে গৌর গোবিন্দের বাড়ি গিয়ে হানা দিল। গোবিন্দ এই তল্লাটের সবচেয়ে পাকা চোর। মাঝবয়সি। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখ দুখানায় বুদ্ধির ঝিকিমিকি। চোর হলেও গোবিন্দ লোক খারাপ নয়। গৌরের মা বেঁচে থাকতে ভাগবত শুনতে যেত, মুড়ি-বাতাসা খেয়ে আসত।
গোবিন্দ উঠোনে বসে পাটের দড়ি পাকাচ্ছিল। গৌরকে দেখে খুশি হয়ে বলল, “আয়, বোস এসে। তা দাদাবউদির সংসারে কেমন আছিস?”
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ভাল নয় গোবিন্দদা।”
“ভাল থাকবি কী করে? ওই যে দুটো গুন্ডাকে আনিয়ে রেখেছে তোর দাদা, ওরাই তোকে মেরে তাড়াবে। সাবধানে থাকিস।”
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তাড়াবে সে আর বেশি কথা কী? বেঁচে যে আছি, এই ঢের। আজ থেকে আবার রাতের খাওয়াও বন্ধ হল।”
“কেন, কেন?”
“কাল রাতে বাড়িতে চোর এসেছিল, সেকথা দাদাকে বলায় দাদা রাতের খাওয়া বন্ধ করে সারারাত জেগে পাহারা দিতে হুকুম করেছে।”
“চোর!” বলে গোবিন্দ সোজা হয়ে বসল। তারপর বলল, “চোরকে দেখেছিস?”
“সেই কথাই তো বলতে এলাম। লম্বা, সুড়ঙ্গে চেহারার বিটকেল একটা লোক রাতে খাউ আর মাউয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে চলে গেল। প্রথমটায় ভেবেছিলাম বুঝি ওদের কাছেই কেউ এসেছিল, চেনা লোকটোক হবে।”
“লোকটা যে চোর তা বুঝলি কী করে?”
“চোর কি না তা জানি না। তুমি এ-রকম চেহারার কোনও লোককে চেনো?”