“খাউ আর মাউটা কে বল তো!” ফকিরসাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
“বউদির ভাই।”
“তা ওদের ও-রকম নাম কেন?”
“সে জানি না। তবে তিন ভাইয়ের নাম হাউ, মাউ আর খাউ। বড়জন হাউ এখন জেলখানায় আছে। ডাকাতির আসামি। খালাস পেয়ে সেও নাকি এসে জুটবে। ফকিরবাবা, আমি বোধহয় বেশিদিন আর বাঁচব না।”
ফকিরসাহেব মোলায়েম গলায় বললেন, “বেঁচে থেকে হবেটা কী? বেঁচে থাকলেই খিদে পায়, খাটতে হয়, লোকের সঙ্গে ঝগড়া লাগে। তার চেয়ে মরে ভূত হয়ে আমার আরশিতে ঢুকে পড়, সুখে থাকবি।”
“তা না হয় থাকব ফকিরবাবা, কিন্তু বেঁচে থাকার দু-একটা সুখ করে আমি মরতে পারব না।”
ফকিরসাহেব দ্রু কুঁচকে বলেন, “বেঁচে থাকায় আবার সুখ কী রে! মরলেই সুখ।”
“কিন্তু আমি যে জীবনে কখনও পোলাউ খাইনি, চন্দ্রপুলি খাইনি, লুচি দিয়ে পায়েস খাইনি, মোটরগাড়িতে চাপিনি, ঢেউপুরের রথের মেলায় সার্কাসের খেলা দেখিনি। আগে এসব হোক, তারপর মরব।”
ফকিরসাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ছেলেমানুষ। একেবারে ছেলেমানুষ। তা যা, ভয় তাড়ানোর তেল একটু দিয়ে দিচ্ছি।” বলে ফকিরসাহেব উঠে ঘর থেকে এক শিশি তেল এনে মন্ত্র পড়তে লাগলেন, “যন্তর-মন্তর-তন্তর সার, ভয়ভাবনা পগার পার। রাক্ষস-খোক্ষস, দত্যিদানো, হাউ-মাউ-খাউ যতই আনন। ভূত-পেতনি, ডাকাত-তস্কর, তফাত হ রে যত ভয়ংকর। বৃশ্চিক, সর্প, সিংহ, ব্যাঘ্র, দূর হয়ে যা শীঘ্র শীঘ্র। নিশুত রাত্রি, অমাবস্যা, হয়ে যা রে একদম ফরসা।” তিনটে ফুঁ দিয়ে ফকিরসাহেব তেলটি তার হাতে দিয়ে বললেন, “কবরেজটার কাছে একদম যাবি না। আর রোজ এক ঘটি করে টাটকা দুধ দুয়ে দিয়ে যাবি সক্কালবেলায়।”
গৌর ঘাড় নেড়ে তেল নিয়ে ফকিরসাহেবের কাছ থেকে বিদেয় হল।
বিকেলে যখন গৌর খিদে-পেটে গোরু চরিয়ে ফিরছে, তখন মহাকাল-মন্দিরের সামনের রাস্তায় কবরেজমশাইয়ের মুখোমুখি পড়ে গেল।
কবরেজমশাই নাক উঁচু করে বাতাস শুকতে শুকতে বললেন, “উ! উ! মহামাস তেলের গন্ধ পাচ্ছি। এই ছোঁড়া, কার গা থেকে গন্ধটা আসছে রে?”
ভয়ে ভয়ে গৌরগোপাল বলে, “আজ্ঞে আমার গা থেকে।”
“তুই এ তেল পেলি কোথায়?”
“ফকিরসাহেব দিয়েছেন। তবে এ মহামাস তেল নয় কবরেজমশাই, এ হল ভয়তাড়ানো তেল। অনেক মন্তর লাগে।”
কবরেজমশাই হাঃ হাঃ করে হেসে বললেন, “ফকরেটা তাই বলে বুঝি! তাদড় তো কম নয়। এই তো বোধহয় গত মঙ্গলবার আমাকে অনেক তোতাই-পাতাই করে পুরনো মহামাস তেলটা ধরে নিয়ে গেল। সেটাই ভয়তাড়ানো তেল বলে বেচেছে বুঝি!”
গৌর ঘাড় চুলকোতে থাকে।
কবরেজমশাই হুংকার দিয়ে বলেন, “তোর আবার ওটার কাছে যাওয়ার দরকারই বা পড়ল কেন? ভয় পাচ্ছিস বুঝি? কীসের ভয়?”
“আমার অনেকরকম ভয় কবরেজমশাই।”
“দেখি তোর নাড়িটা।” বলে কবিরাজমশাই অনেকক্ষণ ধরে গৌরগোপালের নাড়ি ধরে চোখ বুজে রইলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “প্রাণপাখিটা যে বড্ড ডানা ঝাঁপটাচ্ছে রে। ভয় হওয়ারই কথা কিনা।”
“তবে কী হবে কবরেজমশাই?”
“বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকগে। আজ আর কিছু খাসনে। কাল একটা পাঁচন তৈরি করে রাখব’খন, এসে নিয়ে যাস। আর ওই ফকরেটার কাছে কখনও যাবি না। জ্যান্ত মানুষ ওর ভালই লাগে না। মানুষ মরলে পরে ওর আনন্দ হয়।”
“যে আজ্ঞে।”
“তোদের পিছনের আমবাগানে একটা মস্ত মৌচাক দেখেছিলাম যেন।”
“ঠিকই দেখেছেন।”
“পিছনের পুকুরটায় খুব পদ্মফুল ফোটে, না?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“তা হলে পদ্মমধুই হবে। খানিকটা দিস তো।” ঘাড় নেড়ে গৌরগোপাল বাড়ির পথ ধরল। কবিরাজমশাই কিন্তু খেতে বারণ করেছেন। কিন্তু খিদের চোটে গৌরের বত্রিশ নাড়ি পাক দিচ্ছে। সকালে যে তেঁতুল-পান্তা খেয়েছিল, সারাদিন রোদে রোদে মাঠে ঘুরে তা কখন তল হয়ে গেছে। উপোস করলে কি আর রক্ষে আছে!
তবু গৌর বাড়ি ফিরে গোয়ালে সাঁজাল দিয়ে পেটব্যথা বলে ঘরে গিয়ে শুয়ে রইল।
গাঁ-গ্রামের লোকেরা সন্ধের পরই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। বাতি জ্বালাবার খরচ অনেক। সন্ধের পর কাজটাই বা কী?
কিন্তু গৌরের ঘুম আসার নাম নেই। ঘড়ি ঘড়ি উঠে খিদের জ্বালায় জল খাচ্ছে। সাত ঘটি জল খেয়ে ফেলল, কিন্তু খিদে মেটবার নামটিও নেই। রাত যখন নিশুতি হয়ে এসেছে, তখন গৌর আর পারল না, উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
বেশ ফটফটে জ্যোৎস্না উঠেছে। সাদা উঠোনটা ধবধব করছে চাঁদের আলোয়।
গৌর চুপিচুপি গিয়ে রান্নাঘরের শিকল খুলে ঢুকল। সে জানে, রান্নাঘরে কিছুই থাকে না। চোরের ভয়ে বাসনকোসন রাখা হয় না এ-ঘরে। তবে মাটির গামলায় কিছু ভাতের ফ্যান হয়তো রাখা আছে, এই ভেবে গৌর মাটির গামলাটা তুলে দেখল। না, নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গৌর বেরিয়ে আসছিল। বাগানের গাছে ফলটল আছে। কিন্তু রাত্রিবেলা গাছের গায়ে হাত দিতে নেই। বউদির ঘরে যদিও বা মুড়ি-বাতাসা কিছু থেকে থাকে কিন্তু তার নাগাল পাওয়া অসম্ভব।
রান্নাঘরের শিকলটা তুলে দিয়ে গৌর উঠোনে নামবার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। উঠোনের পশ্চিম দিকে দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। গৌর ছায়ায় সরে দাঁড়ায়।
দরজা খুলে খাউ আর মাউয়ের ঘর থেকে ঢ্যাঙামতো একটা লোক বেরিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে উঠোনটা পেরিয়ে চলে গেল। জ্যোৎস্নায় লোকটার মুখ ভাল দেখা গেল না বটে, কিন্তু গৌরের মনে হল, লোকটার মুখে দাড়ি আছে। আর চোখ দুটো মনে হল বেশ গর্তে ঢোকানো। লোকটা উঠোন পেরোবার সময় চারদিকে চোখ ঘঘারাতে ঘোরাতে যাচ্ছিল।