কবচটা না? হ্যাঁ, সেই কবচটাই তো মনে হচ্ছে! গোবিন্দদা কী যেন বলছিল? হ্যাঁ, বলেছিল যে ঝিলিক দেখা গেছে। তার মানে কি কবচটা জেগে উঠেছে।
কবচটা মুঠোয় চেপে শোয়া-অবস্থা থেকে গৌর উঠে দাঁড়ায়। কোনও অসুবিধে হয় না তার। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়, আজ রাঘবরাজার হুকুমে তার চারজন অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ক্ষীকে এই চোরাবালিতে ডুবিয়ে মেরেছে। মনটা হায়-হায় করে ওঠে গৌরের। তার বুদ্ধিনাশ হয়ে গিয়েছিল। শোকে পাগলের মতো হয়ে গৌর চারদিকে বালির মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগল ওঁদের। খুঁজতে খুঁজতে চোখের জল ফেলে সে বারবার বলছিল, “এ আমি কী করলাম! এ আমি কী করলাম!”
বেশি খুঁজতে হল না। প্রথমে কবরেজমশাইকে পেয়ে গেল সে। তারপর সুবলদাদু। একটু বাদেই হাত ঠেকল গোবিন্দদা আর ফকিরসাহেবের গায়ে।
একে-একে চারজনকেই টেনেহিঁচড়ে ওপরে নিয়ে এল গৌর। চোরাবালিতে একটুও কষ্ট হল না তার। শরীরটা যেন পালকের মতো হালকা।
চারজনকেই ঘাসজমিতে শুইয়ে একে-একে নাড়ি দেখবে বলে গৌর প্রথমে কবরেজমশাইয়ের কবজিটা ধরতেই কবরেজমশাই ঘেঁকিয়ে উঠলেন, “ওঃ, কী আমার ধন্বন্তরি এলেন যে! বলি নাড়িজ্ঞানটা আবার তোর কবে থেকে হল?”
গৌর আনন্দে কেঁদে ফেলে বলল, “আপনি বেঁচে আছেন কবরেজমশাই?”
“মারে কে? চোরাবালিতে পড়ার আগে একটা করে বিশল্যকরণীর বড়ি খেয়েছি না সবাই? মরা কি অত সোজা? তা ছাড়া, কবচ যে জেগেছে, সে-খবরও পেয়েছিলাম কিনা। যাকগে, তোকে ভাবতে হবে না। ওই তিনজনও বেঁচেই আছে। এক্ষুনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে।”
গৌর অবাক হয়ে দেখল, সত্যিই তাই। কথা শেষ হতে না হতেই গোবিন্দদা, সুবলদাদু আর ফকিরসাহেব উঠে বসেছেন। একটা হাই তুলে ফকিরসাহেব বললেন, “বেশ ঘুম হল একখানা। ঘুমটার বড় দরকার ছিল।”
গোবিন্দদা গা থেকে বালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “এখন বসে গল্প করার সময় নেই গো। কবচ জেগেছে, কিন্তু যোগেশ্বরবাবার বলা আছে, মস্ত বিপদের দিনে কবচ জেগে উঠবে বটে, তবে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। তারপর যেই ভোর হবে, অমনি চিরতরে নিভে যাবে। সুতরাং যা করার এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। ওঠো সব, উঠে পড়ো।”
৮. রাঘবরাজার গুপ্ত আবাসের কথা
রাঘবরাজার গুপ্ত আবাসের কথা তার সাঙ্গোপাঙ্গরা কেউ জানে না। জানা সম্ভবও নয়।
নদীর বাঁকের মুখে যেখানে স্রোত ভয়ংকর, সেইখানে দক্ষিণ তীরে মাটির মধ্যে কিছু ইট গাঁথা আছে দেখা যায়। কোনও প্রাচীন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ বলে লোকে তেমন মনোযোগ দেয় না। তা ছাড়া ওই জায়গাতেই নদীর মধ্যে একটা ঘূর্ণি আছে। মানুষ, নৌকো, যা পড়বে তা-ই তলিয়ে যাবে। তাই ভয়ে কেউ ওই খাড়া পাড় আর ঘূর্ণির কাছাকাছি যায় না। তবে সাধারণ মানুষ যা পারে না, রাঘবের কাছে তা খুবই সহজ কাজ।
নিশুত রাতে রাঘব সেই খাড়া পাড়ের ধারে এসে দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার দেখে নিল। তার বাঘের মতো চোখ অন্ধকারেও সবকিছু দেখতে পায়। না, কোথাও কেউ নেই। কেউ তাকে লক্ষ করছে না। রাঘব নিঃশব্দে পাড়ের ধারে ইটের খাঁজে পা রাখল। তারপর অলৌকিক দক্ষতায় ঠিক টিকটিকির মতো প্রায় পনেরো হাত খাড়াই বেয়ে খরস্রোত জলের মধ্যে ঝুপ করে নামল। সেখানে জলের স্রোত এমন প্রবল যে, হাতি অবধি ভেসে যায়। কিন্তু রাঘব ভেসে গেল না। এমনকী, খুব একটা টললও না। জলের মধ্যে টুপ করে ডুব দিল সে। ডুব দিয়ে গভীর থেকে গভীরে নেমে গেল। একদম তলায় যখন নামল, তখন তার কাছ থেকে মাত্র কয়েক হাত দুরে পাতালের এক গহিন গহ্বর। নদীর জল চোরাস্রোতে বিভীষণ বেগে সেই গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে। একটু পা হড়কালেই সেই গহিন গহ্বরের উন্মত্ত জলরাশি কোথায় কোন পাতালগঙ্গায় টেনে নিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। অন্ধকারে একবার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে রাঘবরাজা গহুরটার দিকে চাইল। সামনে নদীর পাড়টা যেখানে এসে নীচে ঠেকেছে, সেখানে ইটের ফাঁকে একটা সংকীর্ণ ফাটল। রাঘব ধীর পায়ে সেই ফাটলের মধ্যে ঢুকল। তারপর কতকগুলো খাঁজ বেয়ে উঠে এল খানিকটা ওপরে।
মাটির নীচে অনেকগুলো সুড়ঙ্গের মতো পথ চলে গেছে নানা দিকে। রাঘব সামনের পথটা ধরে একটু নিচু হয়ে লম্বা পা ফেলে দ্রুত এগিয়ে চলল। ক্রমে সুড়ঙ্গটা চওড়া হতে হতে একটা মস্ত হলঘরের মতো জায়গায় এসে শেষ হল। সুড়ঙ্গটা পাথর দিয়ে বাঁধানো। দেয়ালে অনেক কুলুঙ্গি। একধারে একটা মস্ত কাঠের বাক্সের ওপর বিছানা পাতা। একটা দীপাধারে দীপ জ্বলছে। রাঘবের আস্তানা।
রাঘব ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে শুকনো পোশাক পরল।
তারপর, দীপটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল কুলুঙ্গির দিকে। কুলুঙ্গিগুলো বেশ চওড়া। প্রত্যেকটাতে একটা করে বড় কাঠের বাক্স, তাতে ঢাকনা দেওয়া। অনেকটা কফিনের মতো।
রাঘব প্রথম বাক্সটা খুলল। দীপের আলোয় দেখা গেল, বাক্সের মধ্যে একটা শুকনো মমির মতো মৃতদেহ। চামড়া কুঁচকে গেছে, চোখ কোটরে ঢোকানো, হাড়গুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। রাঘব ঢাকনাটা বন্ধ করে দিল। আর-একটা খুলল। এটার মধ্যেও আর-একটা মৃতদেহ। তেমনই শুকনো, কোঁচকানো। একটার পর একটা বাক্স খুলল রাঘব। আবার বন্ধ করল। এসবই রাঘবের পূর্বপুরুষের মৃতদেহ। বহুঁকাল আগে তাদের বংশে মৃতদেহ সংরক্ষণের প্রথা চালু হয়। প্রাসাদ থেকে একটি গুপ্ত সুড়ঙ্গপথে মৃতদেহগুলি এই পাতালঘরে এনে রাখা হত। সেই সুড়ঙ্গ এখন বুজে গেছে। নদীর তলা দিয়ে এখানে আসার পথটি আবিষ্কার করেছে। রাঘব নিজেই।