রাঘবরাজা মৃদু হেসে বলল, “আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে। কাল থেকে আমার সত্যিকারের কাজ শুরু হবে। কাল সকালে এসে এইখানে হাজির হবি। তোর যা এলেম দেখছি, তোকেই সর্দার করে দেব। এই নে আমার পাঞ্জা।”
রাঘবরাজা একখানা তুলোট কাগজ গৌরের হাতে দিল। তাতে একখানা প্রকাণ্ড হাতের ভুসো কালির ছাপ। গৌর কাগজটা নিয়ে কপালে ঠেকাল।
রাঘবরাজা বলল, “খুব সাবধানে রাখিস।”
“যে আজ্ঞে।”
“এখন বাড়ি গিয়ে ঘুমো। কাল অনেক কাজ।”
গৌর হাতজোড় করে বলল, “হুজুর, একটা কথা। অভয় দেন তো বলি।”
“বল বল, অত সংকোচ কীসের?”
“আমার দুই কুটুমকে পাচ্ছি না। খাউ আর মাউ। তাদের খুঁজে নিয়ে না গেলে দাদা বাড়িতে ঢুকতে দেবে না বলেছে।”
একথায় রাঘবরাজার চোখ দুটো ঝলসে উঠল। পিদিমের ম্লান আলোতেও দেখা গেল, লম্বাটে মুখোনা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। চাপা হিংস্র গলায় বলল, “কে তোকে বাড়ি ঢুকতে দেবে না? কার এত বুকের পাটা? তোর দাদাকে যদি কড়াইয়ের মধ্যে পুরে আগুন দিয়ে বেগুনপোড়া না করি…”
“আজ্ঞে হুজুর, মায়ের পেটের ভাই। অতটা করার দরকার নেই।”
রাঘবরাজা কুটি করে কিছুক্ষণ গৌরের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “খাউ আর মাউ কোনও কর্মের নয়। বরং ওদের বড়ভাইটা কাজের লোক। খাউ আর মাউকে বেঁধে বুড়ো শিবের মন্দিরে বন্ধ করে রেখেছি। ভেবেছিলাম কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দেব। আমার রাজ্যে অপদার্থের স্থান নেই।”
“হুজুর, আমারও তাতে অমত নেই। বলেন তো নিজের হাতেই কাটব। তবে বউদি বড় কান্নাকাটি করবে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাঘব বলে, “ঠিক আছে। তুই ওদের নিয়ে যা। একটু নজরে নজরে রাখিস। তোর মুখ চেয়েই ওদের ছেড়ে দিচ্ছি।”
আধমরা খাউ আর মাউকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে গৌর। তারপর খুব নিশ্চিন্তে নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়েছে। ভারী নিশ্চিন্ত। কবচ হারানোর দুঃখ আর নেই। কবচের বদলে রাঘবরাজার পাঞ্জা পেয়ে গেছে সে। আর দুঃখ কীসের? কাল থেকে সে হবে রাঘবরাজার দলের সর্দার। গ্রাম জ্বালাবে, মানুষ মারবে, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে। তারপর একদিন হবে রাঘবরাজার সেনাপতি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গৌর স্বপ্ন দেখছিল। সেনাপতি হয়ে সে ঘোড়ায় চেপে সৈন্যসামন্ত নিয়ে একটা রাজ্য জয় করে ফিরছে। তার বল্লমের আগায় গাঁথা একটা নরমুণ্ড। নরমুণ্ডটা ভারী চেনা-চেনা। কিন্তু ঠিক মনে পড়ছিল না মুখটা কার।
হঠাৎ আকাশ থেকে একটা ইগল পাখি শো করে নেমে নরমুণ্ডটা তুলে নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছিল। গৌর কি কিছু কম যায়? সঙ্গে সঙ্গে ধনুক বাগিয়ে তির ছুড়ল। পাখিটা লাট খেয়ে পড়তে লাগল। আশ্চর্য! নরমুণ্ডটা এসে আবার বল্লমে গেঁথে গেল। আর ইগলটা নেমে এসে হঠাৎ দুটো থাবায় চেপে ধরল তার গলা।
গৌরের দম বন্ধ হয়ে এল। চোখ কপালে উঠল। কিন্তু কিছুতেই ইগলটা ছাড়ছে না তাকে। চোখের সামনে যেন বিদ্যুতের ঝিলিক দেখা গেল বারকয়েক। আর সেই যন্ত্রণার মধ্যে গৌর বুঝতে পারল, বল্লমে গাঁথা নরমুণ্ডটা আসলে তারই মুখ। তাই অত চেনা।
ঘুম ভাঙতেই গৌর বুঝল, মস্ত একটা মানুষ অন্ধকারে প্রাণপণে লোহার থাবায় তার গলা চেপে ধরেছে। বুকে হাঁটু।
গৌর বুঝল, আর একটু পরেই সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তাই পা দু’খানা তুলে সে লোকটার গলায় লটকে একটা ঝটকা দিল। দড়াম করে লোকটা খসে গেল তার বুক থেকে। গৌর বিদ্যুদবেগে উঠে লোকটাকে একটা লাথি লাগাল কষে। তারপর অনায়াসে তার একটা হাত পিঠের দিকে ঘুরিয়ে অন্য হাতে গলা চেপে ধরল।
গৌরের এই বজ্ৰবাঁধনে লোকটা খাবি খাচ্ছে। গৌর জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
“আমি হাউ। খাউ আর মাউয়ের বড়ভাই।”
গৌর অবাক হয়ে বলল, “তুমি তো জেলখানায় ছিলে!”
“রাঘব আমাকে ছাড়িয়ে এনেছে। তারপর ন’পাড়ায় লুকিয়ে ছিলুম।”
“তা আমার ওপর তোমার রাগ কীসের?”
“আমার ভাইদের এই হেনস্থার জন্য তুই-ই দায়ী। তুই রাঘবরাজার নজরে পড়েছিস। এখন রাঘব আমাদের পাত্তা দিতে চাইছে না। তোকে খুন করা ছাড়া আমার অন্য উপায় ছিল না।”
“তুমি ন’পাড়ার কাবাডির দলে ছিলে?”
“হ্যাঁ। রাঘব হুকুম দিয়েছিল, খেলার মধ্যে যেন তোমাকে খুন করা হয়।”
“এখন যদি তোমার ঘাড়টা ভেঙে দিই।” হাউ কোনও জবাব দিল না। কিন্তু আচমকাই পিছন থেকে বেড়ালের পায়ে চার-পাঁচজন লোক ঘরে ঢুকল। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠি, তলোয়ার, খাঁড়া।
গৌর কিছু করার আগেই তার মাথায় বিশাল একটা লাঠি সজোরে এসে পড়ল। ফটাস করে একটা শব্দ আর সেই সঙ্গে ছড়াক করে খানিক রক্ত ছিটকে পড়ল মেঝেয়। তারপরেই উপর্যুপরি ধুপধাপ লাঠি এসে পড়তে লাগল চারধার থেকে। গৌর নড়বার সময় পেল না। লাঠির ঘায়ে কাটা কলাগাছের মতো অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
হাউ লোকগুলোর দিকে চেয়ে বলল, “লাশ এখানে ফেলে রাখা চলবে না। রাঘব সন্দেহ করবে। রক্তটা ভাল করে মুছে দে। আর চারজন ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে আয়। সর্দার হওয়া ওর বের করছি।”
নিশুত রাতে চারজন লোক গৌরের অচেতন দেহখানা চ্যাংদোলা করে বটতলার ঢিবিটার ওপর নিয়ে তুলল। তারপর দু’বার দোল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল চোরাবালির মধ্যে।
বালির মধ্যে আস্তে-আস্তে মিলিয়ে গেল গৌর। কেউ কিছু জানতে পারল না।
গৌরের চেতনা যখন ফিরল, তখন তার চারধারে বালি আর বালি। ওপরে বালি, নীচে বালি, চারধারে ঝুরঝুর করে ঝুরো বালির স্তর কেবল সরে যাচ্ছে, ঝরে পড়ছে। কিন্তু অবাক কাণ্ড! গৌরের তাতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। সে দম নিতে পারছে। সে অনুভব করছিল, বালির মধ্যে শক্তমতো ছোট একটা জিনিস বারবার তার হাতে, পিঠে, বুকে এসে ঠেকছে। গৌর হাত বাড়িয়ে জিনিসটা মুঠোয় নিল।