গৌর চুপ করে রইল। রাজা রাঘব বলল, “আমি তোর ওপর খুশিই হয়েছি। যদিও তুই যোগেশ্বরের এক চেলার নাতির নাতি, তবু তোকে ক্ষমা করতে পারি। একটা শর্তে।”
“কী শর্ত?”
“আমার হয়ে কাজ করতে হবে। একটু বেচাল দেখলেই খুন করব। আর কথামতো চললে কোনও অভাব থাকবে না।”
“আমাকে আপনার দলে নিতে চান?”
“চাই। তবে আমার দলে আসতে গেলে শুধু গায়ের জোর থাকলেই হবে না। শক্ত কলজে চাই। যদি সেই পরীক্ষায় পাস করতে পারিস, তবেই দলে আসতে পারবি।”
“কী পরীক্ষা?”
“হাসতে হাসতে খুন করতে পারা চাই। রক্ত দেখে ভিরমি খেলে হবে না। গেরস্তের ঘরে আগুন দিবি, কিন্তু বুক কাঁপবে না। পারবি?”
“আপনি বললে চেষ্টা করতে পারি।”
“পরীক্ষা এখনই হবে। আমার লোকেরা ফিরে এল বলে।” বাস্তবিকই কয়েক মিনিট বাদে যমদুতের চেহারার কয়েকজন লোক পিছমোড়া করে বেঁধে টানতে টানতে চারজন লোককে এনে হাজির করল। গৌর দেখল, গোবিন্দদা, কবরেজমশাই, ফকিরসাহেব আর সুবলদাদু। তিনজনেই ভয়ে জড়সড়, মুখে কথা নেই।
রাঘব চারজনকে খুব তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে গৌরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, “এই চারটে মর্কটের কথাই বলেছিলি তো।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“এখন এক-এক করে এদের ধরে নিয়ে গিয়ে চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে আয়। খবরদার, চালাকির চেষ্টা করিস না। আমার লোক নজর রাখবে। ওদিকটায় জলার ধারে একটা ঢিবি আছে। ঢিবির ওপর এক-একটাকে দাঁড় করিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবি। যা। এইটাই তোর পরীক্ষা।”
গৌর বলল, “যে আজ্ঞে।” বলেই গৌর গিয়ে কবরেজমশাইয়ের হাত ধরল। কবরেজমশাই ফোঁত করে একটা শ্বাস ছেড়ে ঢোক গিলে বললেন, “বাবা গৌর, তোর মনে কি এই ছিল?”
পিছন থেকে এক যমদূত একখানা রদ্দা মারতেই কবরেজমশাই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। গৌর তাঁকে ধরে তুলল। তারপর হঠাৎ যমদূতটার ঘাড় ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “এ শিকার আমার। স্বয়ং হুজুর সামনে রয়েছেন। এরকম বেয়াদবি আর করলে মুণ্ডু ছিঁড়ে দেব। খেয়াল রেখো।”
সকলেই অবাক হয়ে গৌরের দুঃসাহস দেখল। যমদুতেরা হয়তো সবাই মিলে লাফিয়ে পড়ত গৌরের ওপর। কিন্তু সেই সময়ে রাজা রাঘব চারদিক প্রকম্পিত করে বলে উঠল, “শাবাশ! এই তো চাই।”
কবরেজমশাই কাঁপতে কাঁপতে ঢিবির ওপর উঠলেন। অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করে বীজমন্ত্র জপ করছেন, শুনতে পেল গৌর। তাদের দু’জনের দু’দিকে চারজন-চারজন করে আটজন বল্লম লাঠিধারী লোক।
কবরেজমশাই কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “গৌর, শেষে ব্রহ্মহত্যার পাতকী হলি? রাঘবের দলে গেলি? ওঃ, ভাবতে পারি না। আর কিনা তুই-ই ছিলি আমাদের শেষ ভরসা! নাঃ, এর চেয়ে মরণ ভাল।”
বলতে বলতেই কবরেজমশাই উচ্চৈঃস্বরে বীজমন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে টিবি থেকে লাফ দিলেন। প্রায় হাত-দশেক নীচে চোরাবালি। গৌর ঝুঁকে দেখল, কবরেজমশাই বারকয়েক হাত-পা ছুড়লেন, তারপর তলিয়ে যেতে লাগলেন বালির মধ্যে।
এর পর সুবলদাদু। তিনি কোনও কথা বললেন না। কথা এমনিতেও কম বলেন। ঢিবির ওপর ওঠার সময় শুধু টাক থেকে একটুকরো সুপুরি বের করে মুখে দিলেন। ওইটেই তাঁর একমাত্র নেশা। তারপর গৌরের দিকে চেয়ে বললেন, “কুলাঙ্গার।”
এই বলে তিনিও লাফ দিলেন। ঠ্যালা ধাক্কা দিতে হল না। ফকিরসাহেব কেবল একবার রোষকষায়িত লোচনে গৌরের দিকে চেয়ে বললেন, “ফুঃ, আমাকে মারা কি অত সোজা রে? শরীরখানা ছেড়েই আরশিতে ঢুকে পড়ব। তারপর কেবল ফুর্তি আর ফুর্তি। তোরা কাঁচকলা খা।” এই বলে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফকিরসাহেব গিয়ে ঢিবির ধারে দাঁড়ালেন। তারপর চোখ বুজে একবার আল্লার নাম স্মরণ করেই মারলেন লাফ।
গোবিন্দ কোনও কথা বলল না, তাকালও না। চুপচাপ উঠে চলে এল ঢিবির ধারে। লাফ মারার আগে চাপা স্বরে শুধু বলল, “ঝিলিক দেখা গেছে। তারপরেই লাফিয়ে পড়ল চোরাবালিতে।
কথাটার অর্থ প্রথমে বুঝতে পারেনি গৌর। তারপর মনে পড়ল। গোবিন্দদাই তাকে বলেছিল যে, কবচ জাগলে বিনা মেঘেও আকাশে তিনবার ঝিলিক দেখা যাবে। কিন্তু গৌরের এখন সে-সব ভাববার সময় নেই। রাঘবরাজাকে খুশি করাই এখন তার জীবনের লক্ষ্য। তার বেশ আনন্দ আর উত্তেজনা হচ্ছিল মনের মধ্যে। সে লোকের ঘরবাড়ি জ্বালাবে, গ্রামের পর গ্রাম শ্মশান করে দেবে, একের পর এক মানুষ মারবে। কী যে মজা হবে! ওঃ! তার গা রীতিমতো গরম লাগছে। রক্তে যেন আগুন লেগেছে। আর বেশ নেশা-নেশা মাতলা-মাতলা ভাব।
গৌর বটতলায় ফিরে এসে রাঘবরাজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে বলল, “খুশি তো হুজুর!”
হুজুর! গৌর যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে রাঘবরাজাকে ‘হুজুর’ বলছে! কিন্তু বলে বেশ ভালই লাগছিল তার। ইচ্ছে হচ্ছিল, রাঘবরাজার পায়ের ওপর মাথা রেখে ধুলোয় গড়াগড়ি খায়। আহা, রাঘবরাজার মতো মানুষ হয় না। মানুষও নয়, দেবতা। গৌরের চোখে আনন্দাশ্রু বইছিল।
রাঘবরাজা গম্ভীর মুখে তার বিশাল দক্ষিণ বাহুটি তুলে বলল, “নাঃ, বাহাদুর আছিস বটে! শাব্বাশ!”
“তা হলে পাস তো হুজুর? দলে নেবেন তো?”
“হ্যাঁ। এবার যা, গাঁয়ের গোটা দুই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে আয়।”
গৌর সঙ্গে সঙ্গে ছুটল। পথের ধারে দুটো খোড়ো ঘরে আগুন ধরিয়ে আবার দৌড়ে ফিরে এল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে, লোকজন প্রাণভয়ে চেঁচামেচি, দৌড়োদৗড়ি করছে, আর গৌর তখন রাঘবরাজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বিগলিত মুখে বলছে, “দিয়ে এসেছি হুজুর। আর কী করতে হবে একবার হুকুম করুন।”