“দেখাই যাক।”
“তোর সাহস আছে গৌর। ঠিক আছে, আমিও পিছনে রইলাম। আড়াল থেকে নজর রাখব। তেমন বিপদ দেখলে অন্তত একটা পাবড়া বা বল্লম তো অন্তত ছুঁড়ে মারতে পারব।”
গৌর একটু হাসল। তারপর অন্ধকারে পথ ঠাহর করে করে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে।
সদরের দিক দিয়ে গৌর গেল না। একটু ঘুরে আমবাগানের পথ ধরল। এ-সব তার চেনা জায়গা, নখদর্পণে। অন্ধকারেও সে বলে দিতে পারে, কোন গাছটায় মৌচাক আছে, কোনটায় কাঠঠোকরার বাসা বা কোনটার প্যাঁচ-খাওয়া শরীরে আছে কুস্তিগিরের আকৃতি।
লোক দুটোকে অন্ধকারেও ঠিকই দেখতে পেল গৌর। কাঁচামিঠে আর বেগমপসন্দ দুটো গাছ একেবারে পাশাপাশি। ভারী ঝুপসি ছায়া। সেই ছায়ায় আরও গাঢ় দুটো ছায়া ঘাপটি মেরে আছে। হাতে কোনও অস্ত্র আছে কি? কে জানে!
গৌর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। একটা গাছ থেকে আর-একটা গাছের আড়ালে কোলকুঁজো হয়ে ছুটে যাচ্ছিল সে। কাবাডি খেলার দক্ষ খেলোয়াড়ের কাছে ব্যাপারটা খুবই সহজ। কিন্তু লোক দুটো বোকা নয়। অন্ধকারে যতই নিঃশব্দে গৌর এগোক না কেন, লোক দুটো কিন্তু ঠিক টের পেল। আচমকা ছায়া দুটো ছিটকে সোজা হল। তারপর সিটিয়ে গেল গাছের আড়ালে।
গৌর চারদিকটা একটু লক্ষ করল। তারপর কাঠবেড়ালির মতো একটা গাছ বেয়ে উঠে গেল খানিকটা ওপরে। এক গাছ থেকে আর-এক গাছে যাওয়া তার কাছে ছেলেখেলার মতো। লোক দুটো যে-গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে, সে দুটো টপকে গৌর সোজা গিয়ে তার ঘরে পিছনটায় নেমে পড়ল। নামল খুবই সাবধানে, আড়াল রেখে। কেউই দেখতে পায়নি তাকে।
হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে তার ঘরের দাওয়ার পাশে হাজির হল।
কেউ কোথাও নেই। খুব সাবধানে উঠে দাঁড়াল গৌর। দাওয়ায় গা রাখল। উঠতে যাচ্ছে, ঠিক এই সময়ে লোহার মতো দু’জোড়া হাত এসে তার দুই বাহু চেপে ধরল।
গৌর একটুও চমকাল না, ভয়ও পেল না। ঘাড় ঘুরিয়ে লোক দুটোকে একটু দেখল। সাক্ষাৎ যমদূতই বলা যায়। কিন্তু গৌরের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। সে জানে, ইচ্ছে করলে বোধহয় এই যমদূতদের সঙ্গেও সে পাল্লা দিতে পারে।
তবে গৌর কিছুই করল না। ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী চাও তোমরা?”
যমদূতদের একজন একটু অবাক হয়ে বলল, “ভয় পাচ্ছিস না যে! খুব তেল হয়েছে, না?”
“তেল হবে কেন? তেল তো দেখছি তোমাদের।” ঘাড়ে একটা রদ্দা মেরে যমদূতটা বলল, “কার কত তেল সেটা আজই বোঝা যাবে। চল!”
রদ্দা খেয়ে গৌরের মগজ নড়ে গিয়েছিল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখে সরষেফুল। তবু শরীরটা ঝাঁকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তোমরা বাপু কথায় কথায় বড় গায়ে হাত তোলো। সবসময়ে কি হাত নিশপিশ করে নাকি?”
‘তা করে। তোর মতো চোরকে হাতে পেলে হাত নিশপিশ করবেই।”
“আমি চোর!” গৌর অবাক হয়ে বলে, “কী চুরি করলাম বলো তো!”
যমদূতটা আর-একটা রদ্দা চালিয়ে বলল, “ন’পাড়া থেকে যে সোনার মেডেল নিয়ে এলি, সেটা চুরি নয়? কবচের জোরে জিতেছিস। ওরকম জেতাকে চুরিই বলে!”
এই বলে যমদূতেরা গৌরকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল। ৮৪।
বনবাদাড়, মাঠঘাট, কাঁটাঝোঁপের ভিতর দিয়ে যেখানে এনে হাজির করা হল তাকে, সে-জায়গাটা গৌরের খুব চেনা। সেই বটতলা, যেখানে একটু আগেই রাঘবরাজার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। এখন আর সিংহাসন নেই, সেই স্বপ্নের মতো আলো নেই। শুধু বাঁধানো চাতালে একটা পিদিম জ্বলছে। আধো-অন্ধকারে লম্বা পায়ে পায়চারি করছে রাঘব। তাকে দেখে বাঘের চোখে চাইল। সেই চোখ, যা দেখলে বাঘেরও বোধহয় রক্ত জল হয়ে যায়।
গৌর রাঘবের চোখের দিকে চেয়ে কেমন অবশ হয়ে গেল। সে টের পেল, রাঘবের সাঙ্গোপাঙ্গরা যতই সাংঘাতিক হোক, তারা কেউ রাঘবের হাজার ভাগের এক ভাগও নয়।
গমগমে স্বরে রাঘব বলল, “আমি কে তা জানিস?”
গৌর মাথা নেড়ে ক্ষীণস্বরে বলল, “জানি। আপনি রাজা রাঘব।”
“আর কী জানিস?”
গৌর একটা খাস ফেলল। তার মনটা ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিরোধ চলে যাচ্ছে। সে সম্মোহিত হয়ে পড়ছে। ক্ষীণস্বরে গৌর বলল, “আপনি আপনার রাজ্য আবার স্থাপন করতে চান। তার জন্য সৈন্যসামন্ত জোগাড় করছেন।”
“তা হলে সবই জানিস দেখছি। যোগেশ্বর নামে একটা শয়তান এখানে একসময়ে থানা গেড়েছিল। তার কয়েকজন শিষ্যসাবুদ এখনও এখানে আছে বলে খবর পেয়েছি। তারা নাকি আমাকে তাড়াতে চায়?”
“জানি।”
“লোকগুলোকে আমি চিনি না। শুনেছি তারা খুব গোপনে ষড়যন্ত্র আঁটছে। তুই জানিস তারা কারা?”
“জানি।”
“নাম আর ঠিকানা বলে যা।”
“আপনি কি তাদের মারবেন?”
“আমার কাজে যে বাধা দেবে, তাকেই সরিয়ে ফেলতে হবে। কোনও উপায় নেই।”
“আমাদের এই গ্রাম কি আর এ-রকম থাকবে না?”
“না। সব ভেঙে ফেলে দেওয়া হবে। বাড়িঘর, মন্দির, সব। আবার সব গড়ে তোলা হবে যেমন আগে ছিল।”
“আর মানুষজন?”
“এখানকার মানুষ একসময়ে শত্রুতা করে আমাদের তাড়িয়েছিল। এখনও তাদেরই বংশধরেরা এখানে বাস করছে। সুতরাং সবাইকে উচ্ছেদ করা হবে। এবার নামগুলো বল।”
“গোবিন্দদা, কবরেজমশাই, ফকিরসাহেব, সুবলদাদু।” রাঘব তার যমদূতদের দিকে তাকিয়ে চোখের একটা ইঙ্গিত করল। যমদূত দুটো চোখের পলকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
রাঘব গৌরের দিকে সেই ভয়ংকর চোখে চেয়ে বলে, “রাজা রাঘব বড় একটা ভুল করে না। কিন্তু তোর ব্যাপারে আজ আমার একটা মস্ত ভুল হয়েছে। কবচের জোরে নয়, নিজের ক্ষমতাতেই তুই আজ অনেক ভেলকি দেখিয়েছিস।”