গৌর চেঁচাল, “বাঁচাও…”
একটা হোঁতকা হাত তার মুখটা চেপে ধরল অন্ধকারে। কানের কাছে কে যেন বলে উঠল, “চেঁচাস না! খবরদার!”
গৌর একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, “গোবিন্দদা!”
“এদিকে আয়, তফাতে গিয়ে দাঁড়াই। কথা আছে।”
কাঁপতে কাঁপতে গোবিন্দর পিছু পিছু সে বাঁশঝাড় পেরিয়ে একটা জংলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল।
হাঁপাতে হাঁপাতে গোবিন্দ বলল, “আর রক্ষে নেই। প্রাণ বাঁচাতে যদি চাস তো এক্ষুনি এখান থেকে পালা!”
গৌর সভয়ে বলল, “কোথায় পালাব গোবিন্দদা? আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই। আর পালিয়েই বা হবে কী? আমার বাঁচার ইচ্ছেও নেই।”
গোবিন্দ চোখ কপালে তুলে বলে, “কেন রে, বাঁচার ইচ্ছে নেই কেন?”
গৌরের চোখে প্রায় জল এসে গেল। “বেঁচে থেকে লাভ কী বলো? রাঘবরাজার তোশাখানা খুঁড়ে বের করবে বলে আমাদের ভিটেছাড়া হতে হবে। তার ওপর যদি প্রাণে কোনওরকমে বেঁচেও যাই, সারাজীবন দাদার শালাদের তাঁবেদারি করে মরতে হবে। খাউ-মাউ তো জুটেছেই, বোম্বেটে হাউও এসে জুটল বলে। বড় ভরসা ছিল কবচখানা। তার জোরেই আজ কাবাডিতে খুব লড়েছিলাম। তা সেটাও গেল রাঘবরাজার পাল্লায় পড়ে। বেঁচে থেকে আর লাভ কী?”
গোবিন্দ একটু মাথা নেড়ে বলল, “সবই জানি রে। তুই ভাবিস তুই বুঝি একা! তা নয় রে বোকা। আমরা কেউ-না-কেউ সবসময়ে তোকে চোখে-চোখে রাখছি। যা-যা ঘটেছে, সব স্বচক্ষে দেখেছি।”
গৌর অভিমানভরে বলল, “দেখেছ! তাও আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে না!”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “উপায় নেই! রাঘবরাজার সঙ্গে পাল্লা টানতে পারি, আমাদের তেমন ক্ষমতা কোথায়? তোকে বশ করে ভেড়া বানিয়ে কবচ-ছাড়া করল, তাও মুখ বুজে হজম করতে হল। কিন্তু কাছে গেলে আমারও তোর মতোই দশা হত।”
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এতকাল কবচটার মহিমা বুঝতে পারিনি। ঘুমন্ত ছিল। আজই কিন্তু কবচটা জ্যান্ত হল। আমার শরীরটায় আজ ঝিলিক খেয়ে গেল বারবার।”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “দুর বোকা। কবচ জাগেনি।”
“জাগেনি? তাহলে এসব হল কী করে?”
“কবচ জাগলে তার লক্ষণ আমরা ঠিকই টের পেতাম। যোগেশ্বরবাবার তুক আছে। কবচ জাগলে আমরা যারা তাঁর চেলা, সবাই নীল আকাশে তিনবার বিদ্যুতের ঝলক দেখতে পাব।”
“তা হলে কী করে এতসব কাণ্ড হল?”
“তুই বড় বোকা গৌর। যে ক্ষমতা আজ তুই দেখিয়েছিস, তা কবচের ক্ষমতা নয়, তোরই ক্ষমতা।”
গৌর বিস্ময়ে হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “আমার? আমি সাতটা দানবকে ও-রকম গো-হারান হারিয়েছি? বলল কী গোবিন্দদা!”
“ঠিকই বলছি। আরে হাঁদারাম, যোগেশ্বরবাবার দেওয়া কবচ যদি জাগত তা হলে কি রাঘব অত সহজে তোকে হিপনোটাইজ করতে পারত?”
গৌর জিজ্ঞেস করে, “তা হলে কবচ জাগত কীসে? কেমন করে?”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলে, “তা জানি না। সে-সব আমাদের যোগেশ্বরবাবা বলে দেননি। তবে এটুকু জানি, ঠিক সময়ে ঠিক যোগাযোগে কবচ জাগবে। আর সেইটেই আমাদের একমাত্র ভরসা। নইলে রাঘবরাজা গাঁয়ের পর গাঁ শ্মশান করে দেবে।”
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আর ভরসা করে কী হবে? কবচ তো চোরাবালিতে ডুবে গেছে।”
“তা বটে। কিন্তু কবচ না থাকলেও তোর নিজের ক্ষমতাও যে কিছু কম নয়, তা তো আজ টের পেলি!”
“সে-ক্ষমতা দিয়ে কি রাঘবরাজার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যাবে?”
“সে-ক্ষমতাটাও যে বড় ফ্যালনা নয় রে। আমরা যারা বুড়োহাবড়া, বয়সের গাছপাথর যাদের নেই, তারা অবধি মরার কথা ভাবি না, তুই ভাবছিস কেন? এখন তুই-ই যে আমাদের বড় ভরসা।”
গৌর অবাক হয়ে বলে, “আমি তোমাদের ভরসা? বলো কী? না হয় গায়ে একটু জোরই আছে, আর কাবাডিও মন্দ খেলি না, তা বলে রাঘবরাজার সঙ্গে পাল্লা দেব এমন সাধ্যি কী?”
গোবিন্দ চিন্তিতভাবে বলল, “গায়ের জোরটাও কিছু ফ্যালনা নয় রে। তাতেও মাঝে মাঝে কাজ হয়। তবে কিনা রাঘবের গায়ে অসুরের জোর। তার ক্ষমতাও অনেক বেশি। কিন্তু তা বলে নিজেকে ছোট ভাবতে নেই। যদি একবার ধরে নিস ‘পারব না’ তা হলে আর কিছুতেই পারবি না। অন্তত ‘পারব’ বলে একটা ধারণা রাখতে হয়।”
গৌর বলল, “তা হলে পালাতে বলছ কেন?”
“পালানো মানেও একটা কৌশল। এইমাত্র দেখে এলাম তোর বাড়িতে রাঘব জনাকয়েক যমদূত মোতায়েন রেখেছে। দুটো বসে আছে তোর ঘরের পিছনে আমবাগানে, আর দুটো কলার ঝাড়ে। ওরা কি তোকে ছাড়বে?”
গৌর অবাক হয়ে বলে, “মারতে হলে রাঘবরাজা তো বটতলাতেই আমাকে মারতে পারত। এমন হিপনোটাইজ করেছিল যে, আমার হাত-পা শরীর একদম অসাড় হয়ে গিয়েছিল। তখন মারল না কেন?”
গোবিন্দ ঠোঁট উলটে বলল, “কে জানে রাঘবের কী লীলা। তবে তোকে যদি মেরে ফেলে তা হলে আর আমাদের রক্ষে নেই।”
গৌর একটু ভাবল। আশ্চর্য এই যে, মাঘবরাজা তাকে কবচ-ছাড়া করায় সে যেমন ভয় পেয়েছিল, এখন আর সেরকম ভয় করছে না। শরীরটা বেশ হালকা লাগছে, গায়ে স্বাভাবিক জোরবলও যেন ফিরে এসেছে। তার চেয়েও বড় কথা, তার মাথায় একটু-আধটু বুদ্ধি-বিবেচনা খেলছে। সে মাথা নেড়ে বলল, “পালানোর কোনও মানেই হয় না। আমার যাওয়ার জায়গাও নেই। তবে আমার মনে হয় রাঘবরাজা আমাকে মারতে চাইছে না। চাইলে অনায়াসে মারতে পারত।”
গোবিন্দ বলল, “তা বটে। তা হলে কী করবি?”
“আমি বাড়ি যাব।”
“যদি যমদূতগুলো তোকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে?”