রাত আরও গম্ভীর হয়েছে। আরও নিশুতি। চারদিক ছমছমে-থমথমে। কেমন যেন মনের মধ্যে ফের সুড়সুড়িটা টের পাচ্ছে গৌর। কী যেন একটা ঘটবে।
গৌর বটগাছটার ছায়ার দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়াল। তার পা সরছিল না। দূর থেকেই সে গলা-খাঁকারি দিয়ে মৃদস্বরে ডাকল, “মাউদাদা! খাউদাদা!”
কেউ জবাব দিল না। গৌর আরও দু’পা এগোল। আবার ডাকল, এবারও জবাব নেই। একটা বিদঘুঁটে উত্তুরে হাওয়া কনকন করে বয়ে গেল, হ্যারিকেনটা দপদপ করে কয়েকবার লাফিয়ে ঝপ করে নিভে গেল। নিকষ্যি অন্ধকার গ্রাস করে নিল চারদিক।
কিন্তু সেই অন্ধকারে এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল। এমন কাণ্ড গৌর আর কখনও দেখেনি।
হ্যারিকেনটা নিভে যাওয়ার একটু পরেই হঠাৎ বটতলার অন্ধকারে দপ করে একটা নীলচে আলো জ্বলে উঠল। খুব উজ্জ্বল নয়, কিন্তু ভারী নরম, ভারী মায়াময় এক আলো। যেন জ্যোৎস্নার সঙ্গে আকাশের নীল রংখানা কে গুলে মিশিয়ে দিয়েছে। সেই অদ্ভুত আলোয় বটতলাটা যেন এক রূপকথার রাজ্য হয়ে গেল। কিছুই আর যেন চেনা যায় না। বুড়ে শিবের ভাঙা মন্দির, বাঁধানো চাতাল, বটের ঝুরি সব যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল। নীল আলোর মধ্যে ফুটে উঠল একটা ধপধপে সাদা সিংহাসন।
গৌর পালাতে গিয়েও পারল না। সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইল সামনের দিকে। আঠাকাঠি দিয়ে যেমন পাখি ধরে, তেমনি করে কে যেন আটকে ফেলল গৌরকে। সে পিছোতে পারল না, ঘুরে দৌড় দিতে পারল না, বরং ধীরে ধীরে চুম্বকের টানে এক পা-এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগল বটতলার দিকে।
এখানে এমন ধপধপে সাদা সিংহাসন এল কোত্থেকে? এমন অদ্ভুত আলোও তো জন্মে দেখেনি গৌর! বটতলায় হাজারটা ঝুরির ভিতরে বিচিত্র এক আলোছায়া। গাছের মোটা গুঁড়িটার কাছে ফাঁকা সিংহাসনটা কে রেখে গেল?
গৌর ধীরে-ধীরে সিংহাসনটার কাছে এসে দাঁড়াল, না, নিজের ইচ্ছেয় নয়। এতক্ষণ যেন এক অদৃশ্য সুতোর টান তাকে নিয়ে এসেছে এইখানে। একটা অদৃশ্য হাত যেন হঠাৎ তাকে থামিয়ে দিল নির্দিষ্ট জায়গায়।
গৌরের চোখে পলক পড়ছে না। বুকের ভিতর সেই গুড়গুড়সুড়সুড়। হঠাৎ একটা সাদা আলোর ঝলকানি দেখতে পেল গৌর। তারপর নিজের চোখকে বিশ্বাস হল না তার সিংহাসনে রাজা রাঘব বসে আছে। সেই অদ্ভুত লম্বা লোকটা। পরনে সাদা
একটা জোব্বা, মাথায় জরির কাজ করা সাদা একটা পাগড়ি।
রাজা রাঘব গৌরের দিকে চেয়ে একটু হাসল। বলল, “খুব বাহাদুর ছেলে তুমি। বহোত খুব। আমি তোমার ওপর খুশি হয়েছি।”
গৌর জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, “আপনি কি ভোজবাজি জানেন?”
রাজা রাঘব মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল, “তা একরকম বলতে পারো। তবে ভোজবাজি মানেই হল বস্তুবিদ্যার সঙ্গে আত্মশক্তির প্রয়োগ। অতসব তুমি বুঝবে না। তবে তুমি যে আজ ন’পাড়ার সঙ্গে কাবাডি খেলায় ভোজবাজি দেখালে, সেটাও একটা বস্তুবিদ্যার কারসাজি।”
গৌর অবাক হয়ে বলল, “বস্তুবিদ্যা? কই, আমি তো কিছু জানি না?”
রাঘব মাথা নেড়ে বলল, “তোমার জানার কথাও নয়। আর সেইজন্যই বস্তুটি তোমার পক্ষে বিপজ্জনক।”
“আমার তো তেমন কোনও বস্তু নেই?”
রাঘব মৃদু মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল, “আছে বই কী! কিন্তু বাঁদরের গলায় যেমন মুক্তোর মালা বেমানান, তোমার মতো আনাড়ির কাছে ওবস্তু থাকাও তেমন বিপজ্জনক। বস্তুটি আমি চাই।”
গৌর এক পা পিছিয়ে বলল, “আমার কাছে কিছু নেই।”
মুহূর্তের মধ্যে রাঘবের হাসিমুখ পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। চোখ দুটো ধকধক করে উঠল। হিংস্র গলায় রাঘব বলল, “পালানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। এই জায়গাটা আমি বন্ধন দিয়ে রেখেছি। আর-একটা কথাও মনে রেখো, যে বস্তুবিদ্যার জোরে আমার লোকদের হাত থেকে বেঁচে বেরিয়ে গেছ, তা দিয়ে আমায় ঠকাতে পারবে না।”
গৌর কী বলবে বুঝতে না পেরে শুধু অপলক চেয়ে রইল।
রাঘব ক্রুর চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, “কবচটা কোমর থেকে খোলো।”
শুনে গৌরের মনে হল, এই আদেশ পালন না করে তার উপায় নেই। ওই কণ্ঠস্বর যেন দৈববাণী। তার একখানা হাত আস্তে-আস্তে কোমরের দিকে উঠে এল।
রাঘব বলল, “কবচটা খুলে নাও। তারপর জলার ধারে ওই চোরাবালিতে ছুঁড়ে ফেলে দাও।”
গৌর কোমরের সুতলিটার গিট খুলল। তারপর কবচটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে জলার দিকে এগিয়ে গেল।
পিছন থেকে রাঘবরাজার গলা গমগম করে উঠল, “ফেলে দাও! ছুঁড়ে ফেলে দাও!”
গৌর কবচসুন্ধু হাতটা মাথার ওপর তুলল। তারপর প্রাণপণ শক্তিতে সেটা ছুঁড়ে দিল জলার দিকে।
তারপর আস্তে-আস্তে ঘুরে দাঁড়াল সিংহাসনের দিকে। কিন্তু বটতলা নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে গেছে আবার। সেই আলো নেই, সিংহাসন নেই। শুধু অন্ধকার থেকে একটা গমগমে গলা বলে উঠল, “এবার বাড়ি যাও।”
শরীরটা দুর্বল লাগছিল গৌরের। এতক্ষণ যে নির্ভয়, নির্ভার মন ছিল, তা আর নেই। এখন তার ভয় করছে, শীত করছে, ঠকঠক করে কাঁপছে সে। তাহলে কি কোনও কার্যকারণে তার কবচটার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল? কবচের গুণেই কি সে ন’পাড়ার সাত-সাতটা দানবীয় খেলুড়েকে মোর করে দিয়েছিল দু’দুবার? আর জাগ্রত সেই কবচের জন্যই রাজা রাঘবের এত দুশ্চিন্তা?
গৌর আর ভাবতে পারল না। সে প্রাণপণে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল।
বাড়িতে ঢোকার মুখেই একটা বাঁশঝাড়। অন্ধকারে দেখতে পায়নি গৌর, একটা বাঁশ ঝুঁকে পড়েছিল রাস্তার ওপর। সেটায় পা বেধে ধমাস করে পড়ে গেল সে। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। ভয়ে সিটিয়ে গেল হাত-পা। সে বুঝল যে, আর রক্ষা নেই। এবার শত্রুপক্ষ তাকে পিঁপড়ের মতো পিষে মারবে।