এই সব ভাবতে কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময় নিয়েছে সে। এর মধ্যেই উপর্যুপরি কয়েকটা লাঠি এসে পড়ল তার ওপর। ভাগ্যি ভাল যে, মশালটা পড়েই নিভে গেছে। অন্ধকারে তাই লাঠিগুলোর সবকটা তার শরীরে পড়ল না। একটা মাজায় লাগল বটে, কিন্তু তো জোরে নয়। বোধহয় বটের কোনও ঝুরিতে ঠেকে গিয়েছিল লাঠিটা। আর দুটো লাঠি পরস্পরের সঙ্গে লেগে কাটাকুটি হয়ে গেল।
কে একজন চাপা স্বরে বলল, “শেষ করে দে! শেষ করে দে! তারপর কবচটা ছিঁড়ে নে কোমর থেকে। নইলে রাজার কাছে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।”
গৌর মাথা বাঁচানোর জন্য একটা হাত তুলে রেখেছিল। একটা লাঠি এসে পড়ল ঠিক তার মুঠোয়। প্রচণ্ড লাগল হাতে। মনে হল চামড়া ছড়ে গেল লাঠির চোটে। কিন্তু গৌর তবু চেপে ধরল লাঠিটা। প্রথমে একহাতে, তারপর দু’হাতে, এক হ্যাঁচকা টান মেরে অদৃশ্য আততায়ীর হাত থেকে লাঠিটা ছিনিয়ে নিয়েই খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে সরে গিয়ে লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল গৌর।
তারপরে অন্ধকারে কী যে হল তা গৌর বলতে পারবে না। তার আনাড়ি হাতের লাঠি অন্ধকারে এলোপাথাড়ি চলতে লাগল। ঠকাঠক-ঠকাঠক শব্দ উঠতে লাগল মুহুর্মুহু। অদৃশ্য আততায়ীদের শরীরেও লাগল বোধহয়। কে একজন চেঁচাল–”উঃ!” আর একজন বলল, “বাবা রে!”
মিনিট কয়েক লড়াই চলার পর গৌর টের পেল, ওরা রণে ভঙ্গ দিচ্ছে। একজোড়া পা বাজারপানে দৌড় মারল। একজন বুড়ো শিবের মন্দিরের দিকে ছুটল। একজন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চার নম্বরটা সত করে কোথায় লুকিয়ে পড়ল লাঠি ফেলে।
হতভম্বের মতো লাঠি হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল গৌর। চার-চারটে লোক যে তার জন্য ওঁত পেতে ছিল, এটা যেন তার বিশ্বাস হল না। চারজনেই যে রণে ভঙ্গ দিয়েছে, এটাও হজম করতে একটু সময় লাগল তার। কোমরে হাত দিয়ে সুতলিতে বাঁধা কবচটা একবার ছুঁয়ে দেখল, গলায় মেডেল বা ট্যাকে টাকা, কিছুই খোয়া যায়নি। তারপর সে জোর কদমে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে।
৭. বাড়ি ঢুকে গৌর একটু অবাক
বাড়ি ঢুকে গৌর একটু অবাক হয়ে দেখল দাদার ঘরের দাওয়ায় হ্যারিকেন জ্বলছে। দাদা আর বউদি বসে বসে মশা তাড়াচ্ছে। প্রথমে গৌর ভেবেছিল রাত হয়েছে, বোধহয় তার জন্যেই উদবেগে দাদা বউদি বসে আছে বারান্দায়। কথাটা ভেবে গৌর একটু খুশিই হয়েছিল। কিন্তু নিতাইগোপালের কথায় গৌরের ভুল ভাঙল।
গৌরকে দেখে নিতাই বলল, “কে রে, গৌর এলি নাকি?”
“হ্যাঁ দাদা।”
“তোর মাউ আর খাউদাদাকে দেখেছিস? তারা এখনও ফেরেনি।”
“তারা তো ন’পাড়ায় কাবাডি খেলতে গিয়েছিল।”
নিতাই ভারী বিরক্ত হয়ে বলল, “সে-খবর শুনেছি। বেকায়দায় পেয়ে তুমি তাদের হেনস্থাও করেছ, কিন্তু তোমার বিচার পরে। তারা গেল কোথায়?”
“আমি তো তা জানি না।”
গৌরের বউদি কান্নাজড়ানো খনখনে গলায় বলল, “তা জানবে কেন? খেয়ে খেয়ে গতর হয়েছে, আমার ভাই দুটো খেলতে গিয়েছিল, ধরে সবাই মিলে মেরেছ, লজ্জা করে না? এখন সত্যি করে বলল, তাদের কী হয়েছে। মেরে পাঁকে পুঁতেচুঁতে দিয়ে আসোনি তো?”
গৌর অবাক হয়ে বলল, “আমি মারব কেন?”
বউদিফুঁসে উঠে বলল, “কেন মারবে তা জানো না? দিনরাত তো হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরছ! চোর গোবিন্দ, বুড়ো কবরেজ আর ভণ্ড ফকিরটার সঙ্গে সাঁট করে ওদের সরানোরও মতলব করেছ, সব জানি। ওরা নিজেরাই আমাকে বলেছে। এই বলে রাখছি, আমার ভাইরা যদি না ফেরে, তা হলে তোমাকে আঁশবটি দিয়ে আমি দু’খানা করে কাটব।”
নিত্যগোপালও রাগের গলায় বলল, “তোমার ব্যবহারে লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে। আবার সোনার মেডেল গলায় ঝুলিয়ে রেখেছ! লজ্জা করে না। মাউ আর খাউ কী এমন দোষ করেছিল যে, সবাই মিলে ওদের ওরকম মারধর করলে?”
গৌর এত অবাক জীবনে হয়নি। কিছুক্ষণ সে কথাই বলতে পারল না, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “ওদের মেরেছি কে বলল?”
“বলবে আবার কে! গাঁয়ের লোকেরাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে গেছে। খেলতে একটু গুতোণ্ঠতি হয়েই থাকে। না হয় তোমাকে একটু ধাক্কাধাক্কিই করেছে তা বলে হাত ভেঙে দেওয়া! ছি!”
“গাঁয়ের লোক কী বলল? তারা কি বলল দোষটা আমার?”
বউদি খনখনে গলায় বলে ওঠে, “তা বলবে কেন? আমার ভাই দুটো এ-গাঁয়ে আছে বলে সকলেরই চোখ টাটায়। সব শত্রু! কী হিহি করে হাসি সকলের! আমার ভাইয়ের হাত ভাঙায় কী আহ্লাদ তাদের! গৌর ভারী বীরত্বের কাজ করেছে তো! কুটুম-মানুষের হাত ভেঙে দিয়েছে। যাও, এবার সোনার মেডেলটা তাদের দেখিয়ে এসো। হুঁ, বীর! মুখে নুড়ো অমন বীরের।”
নিতাই বলল, “অত কথায় কাজ নেই। হ্যারিকেনটা নিয়ে যা, যেখানে পাস খুঁজে নিয়ে আয়। আমরা শুতে যাচ্ছি। সকালের মধ্যে যদি তারা না ফেরে, তবে আমাকে পুলিশে খবর দিয়ে তোকে হাজতে পাঠাতে হবে।”
চোখের জল মুছে গৌর হ্যারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
গৌরের সন্দেহ নেই যে, মহাবীর থানের বটতলায় যারা তাকে আক্রমণ করেছিল, তাদের মধ্যে মাউ আর খাউ ছিল। খেলার মধ্যে কী হয়েছে তা সেই উত্তেজনায় গৌরের আর মনে নেই। তবে মাউ বা খাউ, কারও হাত ভেঙেছে বলে তার মনে হয় না। যদি ভেঙে থাকে, তা হলে অবশ্য লজ্জার কথা।
গৌর হারিকেন হাতে মহাবীর থানের দিকে হাঁটছিল। যদি ওদের পাওয়া যায় তবে ওখানেই পাওয়া যাবে।